Learning Hub

হাব অব লার্নিং শিক্ষা বেসরকারিকরণের নয়া রোড ম্যাপ

উত্তর সম্পাদকীয়​

নিলয় সাহা

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি দ্রুত কার্যকর করতে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর গত ৬ অক্টোবর, ২০২৩ এক আদেশনামা প্রকাশ করে। এই আদেশনামায় উচ্চশিক্ষা দপ্তর ‘ক্লাস্টার’ বা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে একত্রিত করে ‘হাব অব লার্নিং’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করেছে। রাজ্য সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ এই নির্দেশিকার অভিনব হলো, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এই প্রথম কোনও রাজ্য বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে একই পরিচালনাধীন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দু’দশকেরও বেশি সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ (ইউ জি সি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূলত মহাবিদ্যালয়গুলিতে ‘ক্লাস্টারিং অব কলেজেস’ অর্থাৎ ‘মহাবিদ্যালয়গু বাস্তবায়নে প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। মনে রাখতে হবে, কেবলমাত্র নিকটবর্তী মহাবিদ্যালয়গুলির মানব সম্পদ এবং পরিকাঠামোগত সুবিধার পারস্পরিক আদান প্রদানই ছিল ওই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড অভিমারীর ভয়াবহ আবহে কোনও স্তরে কোনোরকম মতবিনিময়ের সুযোগ না দিয়ে, এমন কি সংসদে আলোচনা না করেই কার্যকর করেছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’। নতুন এই শিক্ষানীতির অন্যতম লক্ষ্যপূরণে ইউজিসি গত বছর ‘গাইডলাইন ফর ট্রান্স ফরমিং হায়ার এডুকেশান ই টিউশানস ইন টু মাল্টিডিসিপ্লিনারি ই টিউশানস’ শীর্ষক নির্দেশিকা জনসমক্ষে এনেছে। এই নির্দেশিকার মুখবন্ধে বলা হয়েছে, “দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক শাখা অথবা বহু শাখা বিশিষ্ঠ হলেও সেগুলি বহুমুখী সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত। কাজেই দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বহুমুখী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর এই নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির একটি চ্যালেঞ্জ। আশা করা যায়, এই নির্দেশিকা রাজ্যের পাশাপাশি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অধীনস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কৃতি বদল করে বহুমুখী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার নিয়ম কানুন প্রস্তুতে সহায়তা করবে। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন তা হলো, ‘নাটুকে’ লড়াইয়ে সিদ্ধহস্ত কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার নীতি নির্ধারণ এবং প্রণয়নে কোনও রকম আলাপ আলোচনায় বিশ্বাসী নয়। রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন পুজো অবকাশের প্রস্তুতি তুঙ্গে তখন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনও পক্ষের সাথে কোোরকম আলোচনা না করে রাজ্য শিক্ষানীতির অংশ হিসাবে ‘হাব অব লার্নিং’ কার্যকর করার সরকারি নির্দেশিকা প্রকাশের মধ্যেই রাজ্য সরকারের সুযোগ সন্ধানী, স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলে। কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘোষিত রাজ্য শিক্ষানীতি এক কদম এগিয়ে এই ‘হাব অব লার্নিং’এর সাহায্যে রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ছাতার নিচে এনে যে ভাবে জেলা শাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, তা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবসার পাশাপাশি রাজ্যের অগণিত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অভিভাবক সমাজকে কোন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে সেই আলোচনা আজ অত্যন্ত জরুরি।
হাব অব লার্নিং— প্রাথমিক ধারণা
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর প্রকাশিত এই আদেশনামার সূচনায় বলা হয়েছে, “সময়ের নিরিখে পরীক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত সাফল্যের দুটি কৌশল হলো— সহকর্মীর শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ পরামর্শদাতার উপস্থিতি। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব। ভৌগোলিকভাবে নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের সাহায্যে সারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের পরিবেশে সমতা এবং একতা বিধান’ই ‘হাব অব লার্নিং’এর উদ্দেশ্যে। মজার কথা, এই ‘হাব অব লার্নিং’ সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশিকার চিঠি লেখা হয়েছে সমস্ত জেলা শাসকের উদ্দেশ্যে এবং নিজের নিজের জেলায় ‘ক্লাস্টার’ গঠনে যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের এই পটভূমিতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কৃত কুশীলব অর্থাৎ ছাত্রসমাজ, শিক্ষাকর্মীবন্ধু এবং শিক্ষককুল সম্পূর্ণ ব্রাত্য। এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলি ধারণা’র উপর ভিত্তি করেই ‘হাব অব লার্নিং’এর উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত হবে। এই মডেল অনুসারে একটি জেলার বিভিন্ন মহাকুমায় অবগতি পরিকাঠামোগত এবং মানব সম্পদে অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হাব’ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং একই ভৌগোলিক স্থানে অবস্থিত অবশিষ্ট বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চিহ্নিত হবে ‘স্পোক’ হিসাবে। শিক্ষার্থীর স্বার্থ রক্ষার্থে ‘হাব এবং ‘স্পোক’গুলির মধ্যে পরিকাঠামোগত সুবিধা এবং মানব সম্পদের আদান প্রদানে কার্যকরী হবে আনুভূমিক সহযোগিতা। আনুভূমিক সহযোগিতা হলো সমস্তরীয় প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অর্থাৎ ‘হাব’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘স্পোক’ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘হাব’ মহাবিদ্যালয় থেকে ‘স্পোক’ মহাবিদ্যালয়ে এবং ‘হাব’ বিদ্যালয় থেকে ‘স্পোক’ বিদ্যালয়ে প্রসারিত সহযোগিতা। অন্য দিকে একই লক্ষ্যে উল্লম্বিক সহযোগিতা কার্যকর হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে। ‘স্পোক’ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পঠনপাঠন এবং পরিচালনগত মানোন্নয়নে যথার্থ নেতৃত্বদানের পাশাপাশি আদর্শ পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করবে ‘হাব’। এই প্রক্রিয়া ‘স্পোক’ অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পাশাপাশি পরিকাঠামো, সম্পদ, পাঠাগার, গবেষণাগার এবং নিজের নিজের সেরা অনুশীলনও আদান-প্রদান করবে। সর্বজনীন গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার, ক্রীড়াঙ্গন ও শরীর চর্চাকেন্দ্র, আবাসন ইত্যাদি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে পরিচালনা করবে বিভিন্ন ‘অ্যাড অন কোর্স’, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা ও কর্মশালা। যৌথ গবেষণা সহযোগিতা এবং যৌথ প্রকাশনার কাজও প্রতিষ্ঠানগুলির ধারণাকে সমৃদ্ধ করবে। এই নির্দেশিকায় দাবি করা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠানগুলির অংশ হিসাবে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক নানাবিধ কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে সক্ষম হবে, যা এককভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বল্প বিনিয়োগ এবং নিজস্ব সীমিত সম্পদে কখনোই সম্পাদন করা সম্ভব নয়।

হাব অব লার্নিং— বিপদের সাতকাহন
অভিনব এই প্রতিষ্ঠানগু প্রকল্প সংক্রান্ত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলায় অন্তত পক্ষে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়, বহু সংখ্যক সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয়, বহু সংখ্যক কারিগরি স্নাতক মহাবিদ্যালয় এবং অসংখ্য বিদ্যালয় নিয়ে গঠিত হবে এক একটি ‘ক্লাস্টার’ বা প্রতিষ্ঠানগুলি। প্রয়োজনানুসারে জেলাশাসক একটি জেলায় একাধিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবেন। তিটি প্রতিষ্ঠানগুলির অধীনে তিনটি হাব থাকবে। হাব তিনটি হলো— জেলার সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয়ের জন্য একটি সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয় হাব, জেলার কারিগরি স্নাতক মহাবিদ্যালয়ের জন্য একটি কারিগরি স্নাতক মহাবিদ্যালয় হাব এবং জেলার সমস্ত বিদ্যালয়ের জন্য একটি বিদ্যালয় হাব। সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয় হাবের অধীনে জেলার সমস্ত সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে স্পোক সাধারণ স্নাতক মহাবিদ্যালয় এক, দুই, তিন ইত্যাদি সাঙ্কেতিক নামে নথিভুক্ত হবে। কারিগরি স্নাতক মহাবিদ্যালয় হাব এবং বিদ্যালয় হাবের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি কার্যকর হবে। উন্নত পরিকাঠামো বিশিষ্ঠ মানব সম্পদে সমৃদ্ধ জেলার সরকারি অথবা সরকার পোষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি অথবা সরকার পোষিত সুপ্রতিষ্ঠিত কোনও একটি বিদ্যালয় বা উচ্চ বিদ্যালয় হাব হিসাবে চিহ্নিত হবে। এই প্রকল্প রূপায়ণ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য এই নির্দেশিকা রাজ্য, জেলা, ক্লাস্টার এবং হাব— এই চারটি

স্তরে চারটি ভিন্ন ভিন্ন কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে। রাজ্য স্তরে প্রস্তাবিত কমিটির কাজ হলো কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা কমিটিগুলিকে পরিচালনা করা এবং সামগ্রিক কাজের অগ্রগতি তদারকি করা। রাজ্য স্তরের কমিটি হলো এই প্রকল্পের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা। জেলা স্তরের প্রস্তাবিত কমিটির উপর অর্পিত হয়েছে জেলার অভ্যন্তরে গৃহীত কর্মসূচি সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ সহ ক্লাস্টার অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্গত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যালয়ের কার্য নির্বাহী কমিটিকে পরিচালনার দায়িত্ব। ক্লাস্টার কার্য নির্বাহী কমিটির কাজ হলো ক্লাস্টার অন্তর্ভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানে গৃহীত কর্মসূচি রূপায়ণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করা। হাব পর্যায়ে দুটি পৃথক কার্য নির্বাহী কমিটি গঠনের সুপারিশ এই নির্দেশিকায় বর্তমান, একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং অপরটি বিদ্যালয়ের জন্য। এই দুটি কার্য নির্বাহী কমিটি হাবের অন্তর্ভুক্ত তিটি প্রতিষ্ঠানের গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক প্রাত্যহিক কাজও তদারকি করবে। কমিটির কোথায়ও ছাত্র, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষক, অভিভাবক কারো স্থান হয়নি। উচ্চশিক্ষাকে এক ছাতার নিচে এনে এই চমকপ্রদ প্রকল্প কার্যকরী করতে চার চারটি কমিটি গঠনের সুপারিশ এই নির্দেশিকায় সবিস্তারে আলোচিত হলেও প্রস্তাবিত এই চারটি বিদ্যালয় শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের বিষয়টি কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সরকারের যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে তাতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ গৃহীত নীতিরই প্রতিফলন লক্ষিত হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সরকার যেমন কোনও প্রকার অর্থ সংস্থানের কথা বলেনি, তেমনি এই নির্দেশিকায় প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয় হাবের নানান কার্যাবলী পরিচালনার জন্য ‘পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন থেকে বাৎসরিক পর্যবেক্ষণ তহবিল ব্যবহারের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা বিভাগ কর্তৃক বিদ্যালয় শিক্ষার ন্যায় কোনও খাত থেকে সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত অর্থহীন। প্রকল্প সম্পর্কিত ব্যয় বরাদ্দের অস্পষ্টতার পাশাপাশি একশো শতাংশ আমলা নির্ভর এই প্রকল্প অচিরেই পরিণত হবে সরকার নিয়ন্ত্রিত এক বধ্যভূমিতে।

হাব অব লার্নিং— অনিবার্য পরিণতি
রাজ্য সরকার এমন একটি সময়ে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবসায় আমূল পরিবর্তন আনতে চলেছে যখন রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা সার্বিকভাবে বিপন্ন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েই সারা রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থার পরিবর্তে কায়েম করেছে মনোনীত পরিচালন ব্যবস্থা, দীর্ঘ সময় রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ ছাত্র নির্বাচন, কোভিড অভিমারীতে সারা পৃথিবীর মতো রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাও চরমভাবে বিপর্যস্ত, বিদ্যালয় ছুটের হার ক্রমবর্ধমান, বিগত এক বছরে রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস সর্বকালীন নজির সৃষ্টি করেছে, রাজ্যের আট হাজার বিদ্যালয় চিহ্নিত হয়েছে যেখানে ছাত্র সংখ্যা পঞ্চাশের কম, বর্তমান শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তির হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের ‘কুস্তির আড়ালে দোস্তি’ শালীনতার শেষ সীমা অতিক্রম করেছে এবং এর ফলে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে চরম নৈরাজ্য, কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে যোগ্য মেধাবী হবু শিক্ষকদের চাকরি বিক্রির অভিযোগে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী সহ একাধিক শিক্ষা প্রশাসক বিচারাধীন, দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে হকের চাকরি আদায়ের দাবিতে মহানগরীর রাজপথে আন্দোলনরত রাজ্যের সম্পদ মেধাবী হবু শিক্ষকেরা। এমন এক অস্থির সময়ে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাস্থ্য পুরুদ্ধারের কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসৃত এই নয়া ফরমান অবাস্তব এবং অকল্পনীয়। প্রস্তাবিত এই নয়া মডেল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণ, রুদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন, নমনীয় বহু বিকল্প পদ্ধতি প্রবর্তন, ইন্ডাস্ট্রি, অর্থ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, মহাবিদ্যালয়ের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদ্যালয় শিক্ষাক্রমে সংযুক্তিকরণ ইত্যাদি চটকদারী ভাবনা উপস্থাপন করলেও এই মডেলের আসল উদেশ্য হলো সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বার রুদ্ধ করে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবসাকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে অর্পণ করা। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ কার্যকর করতে ইউজিসি কেবলমাত্র দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সংযোগস্থাপন, একত্রীকরণ এবং প্রতিষ্ঠান গুচ্ছ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলিকে বহুমুখী উচ্চশিক্ষা তিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও রাজ্যের উচ্চশিক্ষা বিভাগ ‘হাব অব লার্নিং’এর সাহায্যে রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ছাতার নিচে আনবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা কার্যত রাজ্যের বর্তমান বিপন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রা সম্পন্ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন রাজ্যবাসী কি এই বিপর্যয়ের অশনি সঙ্কেতেও নিশ্চুপ থাকবেন?

Comments :0

Login to leave a comment