‘আমার আম্বানিকে চাই। আদানিকে চাই।’ মমতা ব্যানার্জি মুম্বাইয়ে বলেছিলেন। ২০২১-র ১ ডিসেম্বর।
২ ডিসেম্বর কী হয়েছিল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে বিস্তর সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা গৌতম আদানি পা রেখেছিলেন নবান্নের ১৪তলায়। সেদিন দেড় ঘণ্টা বৈঠক হয়েছিল গৌতম আদানি আর মমতা ব্যানার্জির। কী আলোচনা হয়েছিল, তা নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি দু’জনের কেউ।
বিস্ময় কী শুধু তাতে? না। আরও আছে। সেই বৈঠকে আরও দু’জন উপস্থিত ছিলেন সেদিন। একজন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো, অভিষেক ব্যানার্জি। আর একজন? সেই সময় তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। কেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে পছন্দের ব্যবসায়ীর একান্ত বৈঠকে এই দু’জনই থাকবেন? প্রশান্ত কিশোর তথা ‘পিকে’-র কোনও পদাধিকার বলে সেই বৈঠকে থাকার কথা?
আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।
সেই গৌতম আদানি ও তাঁর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবারে সরাসরি ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগ জানিয়ে নিউইয়র্ক কোর্টে মামলা দায়ের করেছে আমেরিকা প্রশাসন। সে খবর সামনে এসেছে বৃহস্পতিবার। এবারও মমতা ব্যানার্জি কোনও কথা বলেননি। বৃহস্পতিবার তিনি নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। কিন্তু কোনও প্রশ্ন নেননি।
গৌতম আদানি, তার ভাইপো সাগর আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন প্রসিকিউটরদের দাবি, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গৌতম আদানি ও তার সহযোগীরা ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির সঙ্গে পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (পিপিই) নিশ্চিত করা। যে ক’টি রাজ্যের আধিকারিকদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে নিউইয়র্কের আদালতে মামলা হয়েছে, তার মধ্যে আপাতত পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই। কিন্তু আদানির বিদ্যুতের জন্যই লাঠি চলেছিল মুর্শিদাবাদে।
দিনটি ছিল ২০২২-র ২ জুলাই। গৌতম আদানির বিদ্যুতের ব্যবসা বাড়াতে ফরাক্কায় গ্রামের নিরীহ মানুষের উপর বেপরোয়া লাঠি চালিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিশ। তার আগে ফরাক্কার বেনিয়াগ্রামের দাদনটোলায় আম ও লিচুর বাগানের উপর দিয়ে বিদ্যুতের হাইটেনশন তার নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে বেশ কয়েক মাস ধরেই আন্দোলন করছিলেন গ্রামের মানুষ। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠাবে আদানি গোষ্ঠী। সেই বিদ্যুতের হাইটেনশন তার যাবে দাদনটোলার আম-লিচুর বাগানের উপর দিয়ে। তা জেনে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। তাঁরা জানিয়েছিলেন, এই কাজে জমি চিহ্নিত করার আগে তাঁদের কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। পরে বিদ্যুতের তার বসাতে এলে কাগজে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির কথা জানতে পারেন তাঁরা। গ্রামের মানুষকে অন্ধকারে রেখেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কাজ করেছে আদানি গোষ্ঠী, প্রশাসন। গ্রামবাসীদের মত জানতে প্রশাসনিক কোনও সভাও ডাকা হয়নি। যখন তাঁদের গ্রামে বিদ্যুতের হাইটেনশন তারের টাওয়ার বসানো হয়, তখনই প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরা। বলেছিলেন, আম-লিচুর বাগান বা বহুফসলি জমি বাদ দিয়ে হাইটেনশন তার নিয়ে যাওয়া হোক ফাঁকা জমির উপর দিয়ে। তাহলেই আপত্তি থাকবে না।
দিনটি ছিল শনিবার। সেদিন সকালে পুলিশ, র্যা ফ সঙ্গে নিয়ে জাফরগঞ্জ মৌজার দাদনটোলা গ্রামে বিদ্যুতের তার লাগাতে যান বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরেও মজুত ছিল পুলিশের বিশাল বাহিনী। গ্রামের বাসিন্দারা বাধা দিলে তাঁদের নির্বিচারে লাঠিপেটা করে পুলিশ। গ্রামবাসীদের দিকে পাথর ছুঁড়তেও দেখা যায় পুলিশকে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে গ্রামবাসীদের মেরেছিল পুলিশ। বৃদ্ধ, শিশু— কোনও রেয়াত করেনি।
আদানিকে জালিয়াতি নিয়ে এই প্রথম বিদেশের মাটিতে আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতি সহ বহু প্রতারণার অভিযোগ উঠলেও আজও তাঁকে আদালতের মুখোমুখি হতে হয়নি। উল্লেখ্য, আমেরিকার সংস্থা হিন্ডেনবার্গ গত বছর তাদের রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার জালিয়াতিতে শেয়ার বাজার থেকে টাকা লোপাটের সব তথ্য ফাঁস করে দেয়। তাতে শেয়ার বাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি ডলার উধাও হয়ে যায়। দেশে আদানির শেয়ার জালিয়াতি নিয়ে তদন্তে বিরোধীরা যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি জানালেও তা মানেনি মোদী সরকার। শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবিও এনিয়ে তদন্ত এড়িয়ে গিয়েছে। মোদীর সহায়তায় দেশে আদানি তাঁর শেয়ার জালিয়াতি থেকে কার্যত রেহাই পেয়ে গিয়েছেন।
২০১৪-এ মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার সময় মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৩৬০ কোটি ডলার। আর আদানির ছিল ৭১০ কোটি ডলার। আর এখন আম্বানি দশ হাজার কোটি ডলার। আর আদানির সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৮৪০০ কোটি ডলার। দশ বছর আগের হিসাব থেকে ১২ গুণ।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই মোদী কচ্ছের রণ, কাণ্ডালা বন্দর সহ গুজরাটে জল, জঙ্গলের অনেকটাই আদানিকে ‘উপহার’ দেন বলে অভিযোগ। আর প্রধানমন্ত্রী হয়ে তো দেশের বন্দর, বিমানবন্দর, খনি সবই প্রায় একে একে তুলে দেওয়া হয়েছে আদানির হাতে। গত বছরই কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীন হলদিয়া বন্দরের ২ নম্বর বার্থে পণ্য ওঠা-নামানোর কাজে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে (পিপিপি মডেল) ৩০ বছরের জন্য চুক্তি হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর। চুক্তির ফলে হলদিয়া বন্দরের ২ নম্বর বার্থে ২ লক্ষ ১১ হাজার বর্গমিটার জায়গা এখন আদানিদের হাতে। ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে আদানি গোষ্ঠী এই বার্থের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করেছে।
রাজ্যে সেই আদানিদের ইতিমধ্যেই নানা সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। পূর্ব বর্ধমান সহ বেশ কয়েকটি জেলায় চালের মিলগুলি কিনে নিচ্ছে আদানিদের সংস্থা। চালের ব্যবসায় ঢুকে পড়ে ছোট ব্যবসায়ীদের ধ্বংস করার পথে তারা। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে আগামীদিনে পড়বেন কৃষিজীবীদের সব অংশ।
আদানিরা আগেও রাজ্যে এসেছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্টতমদের অন্যতম এই শিল্পগোষ্ঠী আগেও মমতা ব্যানার্জির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আদানিদের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকেই শোনা গেছে— আগে।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির কথা এবার তৃণমূল নেত্রী মনে করিয়ে দেননি।
দিনটি ছিল ১৭ জানুয়ারি। ২০১৮। সামনে ছিল পঞ্চায়েত ভোট। বছর পেরোলেই লোকসভা নির্বাচন। তৃতীয় বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেছিল তৃণমূলের সরকার। দু’দিনের সম্মেলন ছিল। ১৬ এবং ১৭ জানুয়ারি। সম্মেলনের দ্বিতীয় তথা শেষ দিনে প্লেনারি অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ভাষণ দেওয়ার আগে একজনই শিল্পপতিকে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আদানি গোষ্ঠীর কর্তা প্রণব আদানি। মোদীর হাত ধরে উত্থান যে বিতর্কিত শিল্পপতি, সেই গৌতম আদানির ভাইপো হলেন প্রণব আদানি। সেদিন মমতা ব্যানার্জির ভূয়সী প্রশংসা করে দাবি করেছিলেন, ‘আমরা বন্দর শিল্পে বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী। অনেক রাজ্যে বন্দর শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছি। সুযোগ পেলে এরাজ্যেও গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরের মতো বন্দর তৈরি করতে আগ্রহী।’ সেদিন আদানিদের আগে বলতে সুযোগ করে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,‘‘আমি খুব খুশি যে আদানি গ্রুপ এরাজ্যে বন্দর তৈরি করতে আগ্রহ দেখিয়েছে।’’
২০২৩-র ২৭ নভেম্বর বহরমপুরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছিলেন,‘‘বন্দর নির্মাণ নয়, উপকূলের জমি আদানিদের পাইয়ে দেওয়াই মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্য।’’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম সেদিন বলেছিলেন, ‘‘ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা পেয়েছে, তাই গুজরাটে বিজেপি যেভাবে উপকূলের জমি পাইয়ে দিয়েছে সেভাবেই এরাজ্যেও আদানিদের জমি পাইয়ে দিতে চাইছে তৃণমূল। এ রাজ্যের অর্থনীতির জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর দরকার, আদানিকে দরকার নেই।’’
মমতা ব্যানার্জি কেন আদানির এত প্রশংসা করেছিলেন? অস্ট্রেলিয়ায় আদানিদের কয়লা খনি প্রকল্পের উদ্যোগ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের প্রতিবাদে মুখ থুবড়ে পড়ছিল। পাঁচামীর প্রস্তাবিত খোলা মুখ কয়লাখনির মতোই অস্ট্রেলিয়ায় আদানিদের কয়লাখনি ব্যাপক দূষণ ছড়াবে— এমন আশঙ্কা ছিল। সেই আদানিদের হাতেই দেউচা পাঁচামীর খোলা মুখ কয়লাখনি থেকে লুটের দায়িত্ব তুলে দিতে চাইছে তৃণমূলের সরকার, প্রশাসনের অন্দরে এই খবর বেশ জোরালো। রাজ্য সরকারের তাই এত মরিয়া ভাব। এত বেপরোয়া মমতা-প্রশাসন।
তাজপুরেও আদানিকে নিয়ে এসেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। ওই প্রকল্পের জন্য আদানি গোষ্ঠীকে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’, অর্থাৎ আগ্রহপত্র দিয়েছিল। বাকি ছিল চূড়ান্ত চুক্তি। কিন্তু তার জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র আদায় করে আনার দায়িত্ব নাকি আদানিদের, রাজ্য প্রশাসনের এমনই দাবি। কিন্তু সেই জট এখনও কাটেনি।
তাজপুরে বন্দর বানানোর দু’বার দরপত্র দেওয়া হয়েছে। একবার ২০২১-র অক্টোবরে। দ্বিতীয়বার ২০২৩-র ফেব্রুয়ারিতে। প্রথমবার কোনও শিল্পপতি আগ্রহ দেখাননি। তাই দ্বিতীয়বার দরপত্র দিতে হয়েছে। তবে সেটি আগেরটিই নয়— কিছুটা সংশোধিত। দ্বিতীয়বার দরপত্রে সাড়া দিয়েছিল মাত্র দুটি সংস্থা। একটি জেএসডব্লিউ ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। দ্বিতীয়টি আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড। জেএসডব্লিউ জানিয়েছে তারা .২৩ হারে কর দেবে রাজ্যকে। আদানিদের দরপত্রে সেই হার .২৫।
আদানিরা পেয়েছিল তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির বরাত।
যাঁদের জমি নেওয়া হবে রেললাইন, ৪ লেনের রাস্তা কিংবা অতিরিক্ত জমির প্রয়োজনে— সেই সব পরিবারের কোনও সদস্যের চাকরি, কাজ হবে? যেমনটি সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকার বলেছিল এবং হচ্ছিল, তেমন কিছু? রাজ্যের যুবক যুবতীরা যাতে কাজের সুযোগ পান, তেমন কোনও শর্ত? না। মমতা ব্যানার্জির সরকার এমন কোনও কথা তার চুক্তিতেই লেখেনি।
আদানিদের সামনে মাথা নত করেছে রাজ্য সরকার। উদাহরণ? চুক্তিপত্রের শর্ত অনুসারে তাজপুরের প্রকল্প এলাকা থেকে একটি সিঙ্গললাইন ট্রেন চলাচলের বন্দোবস্ত রাজ্য সরকারকে করতে হবে। সবচেয়ে কাছের ট্রেন লাইনের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটাতে অনেকটা জমি নিতে হবে সরকারকে। তাতে চাষের জমি আছে। গ্রাম আছে কিছু। সরকার কী করে এসব নিয়ে তার কোনও ঘোষণা এখনও নেই। কিন্তু রেলের অনুমতি নিতে হবে মোদী সরকারের কাছ থেকে। বিজেপি-তৃণমূলের কুস্তি সম্পর্কে আদানিদের কোনও ধারণা নেই? হতে পারে?
আরও কী দেওয়া হচ্ছে আদানিদের, যদি তারা বন্দর করেন? তাজপুরে ১১২৬ একর জমি রাজ্য সরকার দিতে চাইছে বেসরকারি বন্দরের জন্য। ১ টাকা লিজে। পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগম সূত্রে জানা গেছে, প্রথম যখন এই প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল ২০১৮-তে, তখন নিগমের পক্ষ থেকে ৩৫ বছরের লিজের শর্ত রাখা ছিল ‘ড্রাফট কনসেসান এগ্রিমেন্ট’-এ। এখন তা করা হয়েছে ৯৯ বছরের। চুক্তিপত্রের ৪.১.২(জি) জানাচ্ছে এই প্রকল্পে কোনও স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন চার্জ দিতে হবে না। এর বাইরে জমি লাগলে সরকার একই হারে তার ব্যবস্থা করবে।
Comments :0