অনির্বাণ দে
টালির চালের ফাঁক দিয়ে দেখা যাবে ঈদের চাঁদ। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মুম্বাই ফেরত নাতিকে গল্প শোনাচ্ছিলেন বছর ষাটের চানু বিবি। যদিও বিষয়টি নিয়ে ‘কাব্য’ করতে নারাজ প্রবীণ মুনসুর শেখ। “এই টালির চাল বেয়েই জল নামবে বর্ষায়। কালবৈশাখীতে জান শুকিয়ে যাব। টালি ভেঙে যাবে । বর্ষায় রাতে ঘুম হবে না। সেটাও বলো”, জুড়ছেন মুনসুর শেখ ।
আসলে, লুটের পঞ্চায়েতের বঞ্চনায় এবারেও নাম নেই আবাস যোজনার লিস্টে। তাই টালির চালের ফাঁক দিয়ে এবারেও ঈদের চাঁদ দেখবে মুনসুর শেখের নাতি, নাতনিরা।
নিজে হাতে জমি পরিষ্কার করে গ্রাম পঞ্চায়েতের ঘর বানিয়েছেন মুনসুর আলি, নুর সেলিম শেখরা । সেটা প্রায় ১৯৯২ সাল। এলাকার মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন , স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। বহরমপুর ব্লকের সেই রাজধরপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতেই আজ পাত্তা পাচ্ছেন না মুনসুর আলি। তাই যান না পঞ্চায়েত।
বার্ধক্য ভাতা পান না, বাড়ির লিস্টে নাম নেই। তাও কেন বারবার ছুটে যাচ্ছেন না পঞ্চায়েতে ?
উত্তর দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইসরাফিল শেখ। ইসরাফিলের কথায়, “ চিনির স্বাদ না পেলে বলদ কেন যাবে ? ওই দরজায় শুধুই দুর্ব্যবহার ”।
চিনির স্বাদ চিনেছে শুধু তৃণমূলের নেতারাই । বঞ্চনাই সম্বল রাজধরপাড়া গ্রাম পঞ্চায়ায়েত এলাকার সাধারণ মানুষের। তাই পঞ্চায়েতের রাস্তা মাড়াচ্ছেন না গ্রামের মানুষ। শুধু দিন গুণছেন পঞ্চায়েত ভোটের।
মাটির মেঝে। তার উপর নিজে হাতে বানানো ইটের গাঁথনি । আর টালির চালা। এক কামরার এই বাড়িতেই বসে মুনসুর শেখ, চানু বিবিরা বলছেন, পালটে গিয়েছে পঞ্চায়েত ।
রমজান মাসে মুম্বাই থেকে কাছে থাকতে এসেছে নাতি সারিউল আলি। স্বামীর মৃত্যুর পর মুম্বাইয়েই পরিচারিকার কাজ করেন মুনসুর শেখের মেয়ে আয়েসা বেওয়া। নাতিকে ঘরে শুইয়ে তাই বারান্দাতেই বিছানা পাতেন চানু বিবি।
তবে চানু বিবির থেকেও নিজের যন্ত্রণা বেশি বলে দাবি করছেন প্রতিবেশী সুরমা বিবি। বারো মাসই ভাঙাচোরা বাড়ির বারান্দা সম্বল বছর ষাটের সুরমা বিবির । ৫ ছেলে , বৌমা নাতিপুতি নিয়ে এক চালার নিচে ২৪ জন ! কীভাবে থাকি বলুন ! তাও ওরা দেখে না ! আক্ষেপ, রাগ ঝরে পড়ছে সুরমা বিবির গলায়। একটাই চালা। তার নিচে পাঁচটা কুঠুরি। এই দেখেই প্রধান, মেম্বাররা খারিজ করে দিয়েছে আবাস যোজনার দরখাস্ত।
বাড়ি পেয়েছে কারা ? উত্তর খুঁজতে বেড়িয়ে আসছে তৃণমূলের নেতা কর্মীদের নাম। বাড়ির তালিকায় নাম থেকে গিয়েছে দোতলা বাড়ির মালিকদের। সোজা কথায়, প্রধান হাওয়ানুর বেগম, তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি রবিউল শেখের নেক নজরে যারা আছেন, তারাই পেয়েছে বাড়ি। বলছেন ভাঙাসাকোঁ পাড়ার বাসিন্দা মফিজুর রহমান।
একশ দিনের কাজে লুটের সাক্ষী রাজধরপাড়া। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লুটের চরিত্র চিনেছেন এই পাড়ার সাগরা বিবিও । স্বামী কাজ করেছেন ঠিকাদারের কাছে, শ্রমিকদের কাজ। পড়াশোনা করাচ্ছেন ছেলে মেয়েকে। ছোট ছেলে রিয়াজ হোসেন এমএ পড়ছে বহরমপুর থেকে। লক্ষীর ভাণ্ডারের অধিকার বুঝে নিতে সাগরা বিবি তিন বার গিয়েছেন বহরমপুর ব্লক অফিসে, টোটো ভাড়া করে। প্রতিবার মুখ ঝামটা শুনেই ফিরতে হয়েছে। ২৭ মার্চ ফের গিয়েছেন। ‘রোজা মুখে অতদুর গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাও কোনো কাজ হয়নি’, বলছেন সাগরা । তিন বছর আগে একশ দিনের কাজ করেছেন সাগরা বিবি। এখনও সেই কাজের তিন হাজার টাকা পাননি। টাকা তুলে নিয়েছে নেতারা।
একশ দিনে কাজে নাকি ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ১২৮ লক্ষ টাকার, ২১-২২ অর্থবর্ষে ১০১ লক্ষ টাকার, কাজ হয়েছে এই গ্রাম পঞ্চায়েতে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে একশ দিনের কাজে ১৬ লক্ষ টাকার কাজ হয়েছে । অথচ শেষ তিন বছরে কাজ চোখে দেখতে পাননি গ্রামের মানুষ। লক্ষীর ভাণ্ডারেও একই কাণ্ড হচ্ছে না তো ? আশঙ্কা সাগরা বিবি , টুনটুনা বিবি, কলসুন বিবিদের গলাতে। ভরসা দেয়নি দুয়ারে সরকার। একদিকে গ্রামে কাজ নেই। অন্যদিকে অভাব। সংসার চালাতে তাই বন্ধন লোন চালু করেছেন টুনটুনা, কলসুনরা। শান্তি নেই রমজানের মাসেও। সপ্তাহে সপ্তাহে আছে বন্ধনের ঋণের কিস্তি শোধ দেওয়ার তাগাদাও। ঋণের ফাঁদে নতুন করে জড়াচ্ছে গ্রাম।
শুধু বাড়ি, একশ দিনের কাজ নয়। লুটের ছবি ফুটে উঠছে রাস্তাতেও। বামফ্রন্টের সময় এই গ্রামের মাঝখান দিয়ে তৈরি হয়েছে কদবেলতলা থেকে কুমড়োদহ ঘাট অবধি পিচরাস্তা। আর এখন, গ্রাম জুড়ে বেহাল দশা রাস্তার। সাইকেল গড়ানোও চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। হাওয়া বুঝেছেন তৃণমূল নেতারাও। তাই বাড়ি কিনছেন বহরমপুর শহরে।
ভাঙা বাড়ির বারান্দায় ঈদের চাঁদের অপেক্ষায় দিন কাটছে সুরমা বিবিদের।
Comments :0