EDITORIAL one nation one vote

স্বৈরাচারের পদধ্বনি

সম্পাদকীয় বিভাগ

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের এক দেশ এক ভোটের জিগির তুলতে চা‍‌ইছে মোদী শাহরা। তাতে পূর্ণ ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে আরএসএস। বেশ কয়েক বছর ধরেই লোকসভা ও সব রাজ্য বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে করার জন্য জনসমর্থন জোগাড়ে ছেঁদো যুক্তি আওড়াচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। বলছে একসঙ্গে ভোট হলে একবারের খরচায় পাঁচ বছরের জন্য সব ভোট করে ফেলা যাবে। আরও বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন সময় ভোট হলে বছরের বেশিরভাগ সময় আদর্শ নির্বাচন বিধির জেরে উন্নয়নের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাই এক সঙ্গে ভোট হলে নাকি উন্নয়নের গতি বাড়বে, বাধাহীন হবে। এই যুক্তি অর্থহীন। একমাত্র লোকসভার ভোটের সময় এক-দেড় মাস আদর্শ নির্বাচনবিধি সারা দেশে চালু থাকে। বিধানসভা নির্বাচনে কেবল সংশ্লিষ্ট রাজ্যে নির্বাচন বিধি কার্যকর থাকে। ফলে সারাদেশে উন্নয়ন থমকে যাবার যুক্তির কোনও মানে হয় না।
হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি আসলে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারক ও বাহক। গণতন্ত্রের বিপরীত মুখে ফ্যাসিবাদের দিকেই এদের স্বাভাবিক প্রবণতা। ভারতের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের কাম্য নয়, তাই পছন্দও নয়। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে স্বৈরাচারী পথে ফ্যাসিবাদের দিকে পা বাড়ানো। বর্তমান প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি ধাপ রাষ্ট্রপতি শাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। আর তারজন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে এক দেশ এক ভোটকে। এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি এক দল, এক নেতার আঙ্গিকেই এক ভোটের ভাবনা। আঞ্চলিক ও রাজ্যগত আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার বাস্তবতাকে নস্যাৎ করে এক সময়ে প্রধানত জাতীয় বা কেন্দ্রীয় ইস্যুতে ভোট করার চেষ্টা। তাতে রাজ্যের বা স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলি হারিয়ে যাবে। গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের পথ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাবে অতি কেন্দ্রীকৃত গণতন্ত্রের দাপটে।
কেন্দ্র-রাজ্যে একসঙ্গে পাঁচ বছর অন্তর ভোটের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে তাতে মাঝপথে সরকার আস্থা হারালে বা সরকারের পতন হলে নতুন করে ভোটের সংস্থান থাকছে না। বিরোধীরা সরকার গড়তে না পারলে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু হবে দেশে। রাষ্ট্রপতি নিজের পছন্দের লোকদের মন্ত্রী নিয়োগ করে সরকার চালাবেন। রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি। সেখানে সরকার চালাবে রাজ্যপালরা, অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রপতি শাসন। সাংসদ-বিধায়ক মারা গেলে বা পদত্যাগ করলে অথবা পদ খারিজ হলে আর উপ নির্বাচনের সুযোগ থাকবে না। স্পষ্টত গণতন্ত্রের পরিসরকে সংকুচিত করে স্বৈরাচারী শাসনের দিকে পা বাড়ানো।
বাজপেয়ী সরকারের সময় আদবানি প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রধান শাসন ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। মোদী ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সেই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এক দেশ এক ভোটের পক্ষে সওয়াল করেন। মোদী সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে ফাঁকা বুলি দেন না। ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়েই বাইরে প্রস্তাব হাজির করেন গণতন্ত্রের মুখোশ পরে। এর আগে আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এর জন্য আইন প্রণয়নের রাস্তা প্রশস্ত করার। নীতি আয়োগও এরজন্য বিস্তারিত সুপারিশ পেশ করে সরকারের কাছে। এবার নরেন্দ্র মোদী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতার কমিটি করে দিয়েছেন সরকারের এই গোপন সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করতে। কমিটি নিয়মমাফিক সব রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। সিপিআই(এম) জবাবে স্পষ্ট করে দিয়েছে তারা এই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে, গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে রাষ্ট্রপতি শাসনের লক্ষ্যে এইভাবে সংবিধান বদলের অপচেষ্টার সর্বোতোভাবে বিরোধিতা করবে সিপিআই(এম)।

Comments :0

Login to leave a comment