রামশঙ্কর চক্রবর্তী
ধান কিনবে সরকার। বড় বড় ফ্লেক্সে ঢেকেছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রতিটি ব্লক এলাকার গঞ্জ। সত্যিই কি সরকার কেনে ধান? তাহলে রেজিস্ট্রেশনের পদ্ধতি জটিল কেন? রেজিস্ট্রেশন পোর্টাল কেন মাঝ রাতে সচল হয়? কাদের মুনাফা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য সরকারের? প্রশ্ন অনেক। তবে উত্তর মিলল সহজে। সবটা বললেন এক তৃণমূল নেতা। উপর থেকেই পোর্টাল সারাদিন লিঙ্ক ফেলিয়ওর রেখে মাঝরাতে সচল করা হয়। সেই খবর পৌঁছে যায় এলাকাভিত্তিক। এবিষয়ে বিস্তারিত পরে আলোচনায় আসা যাক।
কার্তিক সংক্রান্তির পর ধান কাটার কাজ শুরু হয়। মূলত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। ইংরেজি মাসের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। ধান কাটা থেকে ঝেড়ে বাড়িতে ফসল তোলা পর্যন্ত ১৫ দিন থেকে একমাস সময় লাগে। পূর্ব মেদিনীপুরের বেশিরভাগ কৃষক অন্যের জমি ভাগে বা খাজনায় নিয়ে চাষ করে। ফলে ফসল তোলার পর তা বেশি দামে বিক্রি হলে খাজনার টাকা মেটানো আর নিজের সংসার চালানোতে সুবিধা হয়। কিন্তু ফসলের দাম না মিললে সমস্যায় পড়ে কৃষক। কৃষকদের ভরসার একমাত্র স্থল সরকারি ব্যবস্থাপনা। কিন্তু সেখানে সহজে ধান বিক্রি করা যায় না। তমলুক ব্লকের এক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার কথা জানা গেল। বাপ্পাদিত্য মাইতি কথা অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ধান বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করতে গেলে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় আগে। একটি কপি প্রিন্ট নিতে হয়। তা নির্দিষ্ট ধান বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেলে সেখান থেকে একটি স্লিপ দেয়। সেই স্লিপে বিক্রয় করার তারিখ ও সিরিয়াল নম্বর লিখে দেয় কর্মীরা। ওইদিন ধান নিয়ে যেতে হয়। তবে এখানেও একটি সমস্যা আছে। তমলুকের ওই কৃষক বলেন ধরা যাক কারও সিরিয়াল নম্বর ১৫০ আছে। সে নির্দিষ্ট করে দেওয়া তারিখে ধান নিয়ে গেল বিক্রি করতে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এমন হয় যে বিক্রয় কেন্দ্রের কর্মীরা বলে আজকে ৫০ বা ১০০ সিরিয়াল পর্যন্ত ধান নেওয়া হবে। বাকিদের পরের দিন নেওয়া হবে। তখন গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া ধান ফিরিয়ে আনতে হয়। নতুবা সরকারি ওই ধান বিক্রয় কেন্দ্রের কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করে ফড়ের লোকেরা। তারা কৃষকদের টোপ দেয় যে কেন আবার বাড়ি ফেরত নিয়ে যাবেন আমাদের বিক্রি করে দিন। তবে কমে বিক্রি করতে হবে। কৃষকরা নিরুপায় হয়ে সরকার নির্ধারিত দাম ২৩০০ টাকার থেকে অনেক কমে ১৫০০-১৭০০ টাকা কুইন্টাল মূল্যে ধান বিক্রি করে দেয়। আর এমন ঘটনা জানাজানি হওয়ার ফলে রেজিস্ট্রেশন করে থাকা অপর কৃষকরাও আর সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চায়না অযথা হয়রানির জন্য। এমনিতেই ব্লক প্রতি একটি করে ক্রয় কেন্দ্র থাকায় ব্লক এলাকার অন্যান্য প্রান্তের কৃষকদের ধান "বয়ানি খরচ" অনেক হয়। ফলে কাছাকাছি থাকা ফড়েদের ধান বিক্রি করা সুবিধা মনে করে কৃষকরা। আর এমনিতেই ধান চাষে সর্বাধিক ব্লক এলাকার গ্রাম গুলিতে ফড়ের লোকেরা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান সংগ্রহের জন্য রীতিমত সার্ভে করে। ধান কেটে, ঝেড়ে ফসল বাড়িতে আনার পর ফড়েরা নিজেরা কৃষকদের বাড়ি থেকে তা কিনে নেয়। তখন কুইন্টাল প্রতি দাম হয় ১৪০০-১৬০০ টাকা। কৃষকরা নিজেদের হয়রানির কথা মাথায় রেখে বাধ্য হয়েই ধান ফড়েদের বিক্রি করে।
অন্যদিকে সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রির আগে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে জটিল পদ্ধতি আর শাসক দলের কারচুপির বিষয় সামনে এল এবার। নন্দকুমার, তমলুক, মহিষাদল, ভগবানপুর ব্লক এলাকার কয়েকজন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সারাদিনের সব সময়েই সরকারি পোর্টালের লিঙ্ক ফেলিয়ওর থাকে। সহজে রেজিস্ট্রেশন করা যায়না। চার পাঁচদিন পর হয়তো নাম রেজিস্ট্রেশন হয়। একটি সূত্রের মারফত জানা গেল ধান বিক্রির এই সময়টা রাত ১১টা বা ১২টার পর রেজিস্ট্রেশনের পোর্টাল সচল হয়। তখন সহজেই রেজিস্ট্রেশন হয়ে যায়। নিমতৌড়ি এলাকার তৃণমূলের এক নেতার সঙ্গে কথা বলা হল এবিষয়ে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন "আমরা আমাদের দলের যারা সমর্থক তাদের আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে রাখি। যখন খবর হয় পোর্টাল সচল থাকবে সেই সময় রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়া হয়।’’ টাকা নেওয়া হয়? ‘‘দেখুন রাতে ওই রেজিস্ট্রেশন করার কাজ হয়। যারা রাত জেগে করে তাদের তো খরচ আছে। তাই ২০০ বা ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়।’’ উত্তর দিলেন তৃণমূল নেতা। পোর্টাল সচল থাকার খবর দেয় কে? ‘‘সেটা বলা যাবে না। তবে এটুকু জেনে রাখুন উপর থেকে খবর আসে।’’ সবাই যদি ধান বিক্রি করতে পারে ভালোই তো হবে, আপনারা সাধারণ কৃষকদের রেজিস্ট্রেশনে বাধা দিচ্ছেন কেন? তৃণমূলের ওই নেতা বললেন,‘‘এর পিছনে বহু কারণ আছে। সবটা বলা যাবে না। তবে এটুকু বলি চাল মিলগুলি চলবে কী করে? কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে তারা ধান কিনে নিতে পারে। সরকারের কাছ থেকে কিনতে গেলে অতিরিক্ত ১হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে চাল মিলের মালিকদের। আমাদের দলকে তারা সময়ে অসময়ে সাহায্য করে তখন কি হবে।’’ তৃণমূল নেতার এই চাঞ্চল্যকর কথা অনুযায়ী ধান বিক্রির ক্ষেত্র পুরোপুরি ফড়েদের হাতে তুলে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত রয়েছে।
Comments :0