Panchayet System

পঞ্চায়েতের গর্ব ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম

সম্পাদকীয় বিভাগ

সন্দীপন রায়
পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শ্রেণিলক্ষ্যে বাস্তবায়িত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই পথ চলা শুরু করেছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কর্মচারীদের নিয়ে সদ্য গড়ে ওঠা ‘‘পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত কর্মচারী সমিতি সমূহের যৌথ কমিটি। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ছিল গ্রামীণ জনগণ তথা কৃষক খেতমজুরের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, গ্রামীণ এলাকার, কৃষি, শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম পথপ্রদর্শক। ১৯৭৭ সালের আগে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা ছিল কায়েমি স্বার্থের ধারক ও বাহক। তাকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে বিসর্জন দিয়ে ১৮৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ সচেতন মানুষ ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায় উন্নীত করেছে। বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও ক্ষমতার গণতান্ত্রিক‍‌ বিকেন্দ্রীকরণের নীতির বাস্তব রূপ ছিল পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। সেই সময় পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে সামন্ত প্রভুদের হাতে তুলে দেওয়ার অপপ্রয়াস ধারাবাহিক ছিল, কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিত্বে গ্রামীণ উন্নয়ন যে সম্ভব তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা ছিল সারা বিশ্বের বিস্ময়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছে পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত দেখতে। সমাজতান্ত্রিক চীন থেকেও প্রতিনিধিত্ব এসেছে ত্রিস্তরীয়, পরবর্তীতে গ্রাম সভার স্তর ধরে কার্যত চার স্তরের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দেখতে। কিভাবে ত্রিস্তরের নির্বাচন প্রক্রিয়া একইসাথে সংগঠিত হয়, গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়ায় উৎসবের মনোভাব নিয়ে মানুষের অংশগ্রহণ কিরকম ছিল দেখার জন্য দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যম উপস্থিত থেকেছে।
১৯৭৭ সালে নির্বাচিত হয়ে এসে‍‌ বামফ্রন্ট সরকার স্থির করে যে, সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রাণবন্ত করা। প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে। এই নির্বাচন নানান কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। প্রথমত, সরাসরি ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায় এই নির্বাচন হয় প্রায় দু’দশক পরে। ফলে গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ এবং উদ্দীপনা শুরু হয়। 


একই দিনে নির্বাচন হয় ৩২২৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৩২৯টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১৫টি জেলা পরিষদে। ২৫ লক্ষের বেশি ভোটদাতা, ৩,৬০,০০০ প্রার্থীর জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। একজন গবেষক দেখেছেন, নির্বাচকমণ্ডলীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এই উৎসাহ এবং স্বতঃস্ফূর্ততার প্রধান কারণ ছিল সরকারি ঘোষণা। এই ঘোষণায় বলা হয়, নির্বাচনের পর গ্রাম উন্নয়নের মূল দায়িত্ব অর্পিত হবে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠান সমূহের উপর। ৭০ শতাংশ নির্বাচক ভোটদানে অংশগ্রহণ করেন। একটি সমীক্ষায় ও গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের ৫৮ শতাংশ মনে করেছিলেন এই নির্বাচন ছিল বিধানসভা নির্বাচন থেকেও উদ্দীপক। ৮৭ শতাংশ ভোটদাতা ভোটদানে আন্তরিক টান অনুভব করেছিলেন —
গ্রামীণ ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দুই ধরনের —
ী স্থায়ী গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করা। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। তখন জাতীয় স্তরে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল ৩২.৩ শতাংশ আর পশ্চিমবঙ্গে এই হার ছিল ১১.৯ শতাংশ। অর্থনৈতিক এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থা কাটাতে প্রয়োজন ছিল উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ। 
ী গ্রামীণ গণতন্ত্র ছিল পঙ্গু। কারণ, অনিয়মিত নির্বাচন। সরাসরি নির্বাচন হয় এর আগে একবার — ১৯৫৭ সালে। গণতন্ত্রের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির ফলে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় আমলাতন্ত্রের দাপট। তার ফলে মানুষের সরকারি অফিসের কয়েক যোজন দূরত্বের তফাৎ। মানুষ দৈনন্দিন সমস্যায় সরকারি অফিসে আসতে পারতেন না।
আর আজ ২০২৩ সালে আরও একবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে ফিরে দেখতে হয়, কি ছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পরিচালনায় বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি আর আজ শুধুই লুঠতরাজ আর ব্যক্তিগত সম্পদের আকাশচুম্বী বৃদ্ধির জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা।
ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম একমাত্র পশ্চিমবঙ্গই ভূমিসংস্কারে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্তনীতির ফলে সেই সময় সারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকরা গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়। বামফ্রন্ট সরকার সেই সময় সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও সারের উপর বিক্রয়কর হ্রাস করে কৃষক সমাজের বেশ কিছুটা সুবিধা করার লক্ষ্যে নীতি গ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে ধান উৎপাদনে প্রথম স্থানে, বনসৃজনে প্রথম স্থানে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রথম স্থানে এবং আলু উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ অবস্থান করেছে। এত সাফল্য সম্ভবপর হয়েছিল গ্রামীণ জনগণের মধ্যে গণউদ্যোগ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক উন্নয়ন ও সাফল্য গ্রামীণ জনগণ ও সর্বস্তরের মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধতার মনে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। বর্গা রেকর্ডের মাধ্যমে বর্গা চাষিদের চাষে নিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল। বর্গা চাষি ও পাট্টা চাষিকে উৎসাহ প্রদান করতে ও কৃষিতে উন্নয়নের স্বার্থে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ, বিনামূল্যে মিনিকিট, সার দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য ব্যাঙ্কে শ্যালো, পাম্পসেট, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে ব্যাপক জোয়ার তৈরি হয়েছিল। আইআরডিপি-আইটিডিপি ও স্পেশাল কম্পোনেন্ট প্রভৃতি প্রকল্পে গ্রামীণ কুটির শিল্পকে উৎসাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। গ্রামীণ বেকারদের স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভর করে তোলার চেষ্টার ফলে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। গ্রামীণ কৃষি ও কুটির শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য যাতে বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা যায় তার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভবপর হয়। যে কোনও ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, খরা, বন্যায় পঞ্চায়েত গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় তার মোকাবিলা করে।


ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কর্মচারী হিসাবে শুধু নয়, উন্নত চেতনার সামাজিক জীব হিসাবে পঞ্চায়েতের অভ্যন্তরের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করেছে পঞ্চায়েত স্তরের কর্মচারীরা। জেলা পরিষদ ছিল, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েতের সচিব, কর্মসহায়ক, চৌকিদার দফাদাররা মানুষের কাছে বন্ধু ছিলেন। পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার অসম্ভব অগ্রগতির বিরুদ্ধে দারুণ অপপ্রচার ছিল, বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা ধারাবাহিক ছিল। এই অপপ্রচারের জবাবে মানুষের বিভ্রান্তি কাটাতে পঞ্চায়েত কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে, পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও শ্রেণিলক্ষ্যে বাস্তবায়িত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই পথ চলা শুরু করেছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কর্মচারীদের সংগঠন পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি। বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে পঞ্চায়েত কর্মচারী সংগঠনগুলোকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সমিতি’, ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েত সচিব সমিতি’ এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত সমিতি সমূহের যৌথ কমিটি’’ গঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রবীন্দ্রলাল মিত্র ও শচীপদ রায় যুগ্ম আহ্বায়ক ‍‌নির্বাচিত হন। এই সভা থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে এই ‘পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি’ পঞ্চায়েত স্তরের কর্মচারীদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের যৌথ ও সাধারণ সমস্যা সমাধানের জন্য তৎপর থাকবে ও পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সংগঠিত প্রচেষ্টা চালাবে।
১৯৪৯ সালের সামন্ততান্ত্রিক বিরোধী আন্দোলনের শহীদ দাশু মণ্ডল ও মতি ধারার নামানুসারে উৎসর্গীকৃত সোনারপুরে দাশুমতি ভবনে ১২-১৩ জুন ’৮৭ পশ্চিমবঙ্গ কর্মচারী সমিতি সমূহের যৌথ কমিটির ১ম রাজ্য কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। কনভেনশন উদ্বোধন করেন রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তথা এ রাজ্যের মধ্যবিত্ত কর্মচারী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা কমরেড অজয় মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ২০১১ সালে রাজ্যে পট পরিবর্তনের পর ইতিহাসখ্যাত দাশুমতি ভবনেরও নাম বদল করে দেয় বর্তমান শাসক দল। অনেক বিরোধিতা, বিক্ষোভের পরও দুই শহীদের নামাঙ্কিত দাশুমতি ভবনের নাম রক্ষা করা যায়নি। দু’দিনব্যাপী এই প্রথম কনভেনশনে আলোচনা ও আত্মানুশীলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে পঞ্চায়েত কর্মচারীরা শপথ নিয়েছিলেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে বাস্তাবিত করতে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশীদার হতে, কর্মচারী জীবনে দাবিদাওয়া পূরণের নিষ্ঠাবান হতে, সর্বোপরি শ্রেণি সচেতন সংগঠন গড়ে তুলতে। প্রথম কনভেনশন গঠন পর্বের তিনটি সমিতির সাথে যুক্ত হয়েছিল আরও দুটি সংগঠন— ওয়েস্ট বেঙ্গল জেলা পরিষদ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ও গ্রাম পঞ্চায়েত চৌকিদার-দফাদার সমিতি। উল্লিখিত পাঁচটি সমিতি থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ১৫ জনের একটি কমিটি গঠিত হয়। যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন রবীন্দ্রলাল মিত্র ও শচীপদ রায়।
প্রথম পর্যায়ে সংগঠনের চমৎকার অগ্রগতি ও সদস্য কর্মীবন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকুশলতার মধ্য দিয়ে সংগঠনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উন্নীত হয়। কর্মী নেতৃত্ব ও সাধারণ সদস্যবৃন্দও এক উন্নত চেতনার পরিচয় দিয়েছেন সেই সময়। ইতিমধ্যে এই সংগঠন ১৯৮৯ সালে বাঁকুড়া জেলায় অনুষ্ঠিত রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির ৯ম রাজ্য সম্মেলন থেকে সহযোগী সংগঠন হিসাবে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ২৪-২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরে শহীদ প্রদ্যোৎ স্মৃতি সদনে দ্বিতীয় রাজ্য কনভেনশন সংগঠিত হয় এবং এই কনভেনশন থেকে সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়।


১৯৮৩ সালের জন্মলগ্ন থেকে দীর্ঘ চার দশকের পথ বেয়ে আমরা একাদশ রাজ্য সম্মেলনের পথে বর্ধমান শহরে। ১৯৮৩ সালের গঠন পর্বের বা ১৯৮৭ সালের প্রথম কনভেনশন‍‌ থেকে যে কমিটি গঠিত হয় তার মধ্যে অবস্থানকারী অধিকাংশ নেতৃত্ব আজ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁরা দেখে যেতে পারলেন না যে মতাদর্শ, শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি, চেতনা নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন, সংগঠন আজও একই পথ ধরে চল্লিশ বছরে পদার্পণ করেও সেই পথ থেকে বিচ্যুতি হয়নি। পশ্চিমবাংলার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবাংলা ২০১১ সাল থেকে বামপথ ছেড়ে ‘ডান পথে’ চলা শুরু করেছিল। তার পরিণতিতে বিশেষত গ্রামীণ অংশের মানুষের জীবনযাত্রার পরিণতি, পশ্চিমবাংলার গর্বের পঞ্চায়েতের কি ভয়ঙ্কর অধোগতি, লুটের পঞ্চায়েতের চেহারা, একদিন পল্লবিত গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মচারীর বর্তমানে কি নিদারুণ পরিণতি তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ত্রিস্তরে সর্বত্র শূন্যপদ, কোনও লোক নিয়োগ নেই, স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ না করে স্বল্প বেতনে অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ (যাদের চাকরির নিরাপত্তাই বড় প্রশ্ন), অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ করে একটা ব্যবস্থা চলছে। ত্রিস্তরে পঞ্চায়েত কর্মচারীদের আজ প্রশাসনের ‘দাস’ অথবা শাসকদলের অনুগত ‘সেবক’ হতে হবে এবং সেটা হতে পারলে তিনি ‘সব পাবেন’। আর এই প্রবণতার বিরুদ্ধেই লড়াই করে ‘পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি’ এগিয়ে চলেছে তাই নয়, এই সময়কালে প্রমাণ করেছে সবভাবে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পরিচালনায় এই সংগঠনের সদস্যদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। অপরদিকে প্রচলিত ধারার বা স্রোতের বিমুখে গিয়ে অধিকাংশ কর্মচারীকে সমবেত করে রাজ্যের ও কেন্দ্রের শাসকের অন্যায়, অমানবিক, আচরণের প্রতিবাদে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগঠিত করছে। রাজ্যের শাসক জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন লুটের রাজনীতি চরিতার্থ করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধেও শ্রেণি সচেতন অংশ হিসাবেই পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি রাস্তায় থেকেছে। পাশাপাশি করোনা মহামারী, আমফানে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনলাইন প্রক্রিয়াকে ব্যবহার ২১ লক্ষ টাকার তহবিল সংগ্রহ করে রাজ্যের প্রায় একশোটি জায়গায় ক্যাম্প তৈরি করে মানুষের পাশে থেকেছে। বিগত দশম রাজ্য সম্মেলন থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি আজ ‘সারা ভারত রাজ্য সরকারী কর্মচারী ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন, ১২ই জুলাই কমিটির অন্তর্ভুক্ত সংগঠন। রাজ্যের দ্বিতীয় সংগঠন হিসাবে পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি আজ সর্বভারতীয় মঞ্চে। এ রাজ্যের পঞ্চায়েত কর্মচারীর লড়াই সংগ্রাম, যন্ত্রণা আর পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আর গর্বের অতীত জানাতে সক্ষম হচ্ছে এই সংগঠন।
এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২১-২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ পঞ্চায়েত যৌথ কমিটির একাদশ রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বর্ধমান শহরে। ২১ তারিখ প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শুরু সম্মেলনের। সম্মেলনে পঞ্চায়েত কর্মচারীর উপর অমানবিক প্রশাসনিক নির্যাতনের কথা যেমন উঠে আসবে তেমনই লুটের পঞ্চায়েতের পরিবর্তে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে, এরাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় অপহৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার হবে এই সম্মেলন।

 

Comments :0

Login to leave a comment