মৈনাক পাল
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের গারো পাহাড়ের নিচে গল্পে প্রথম পড়েছিলাম পাহাড় জ্বলার কথা। গল্পে যে জিনিসটা পড়েছিলাম সেটা দেখলাম নিজের চোখে। গত ৪ মে। এই দিনটা কোনোদিন ভুলবো না। ভোলার কথা নয়।
এনআইটি মণিপুরের জানালা দিয়ে দেখছি আগুনে জ্বলছে লাঙ্গল পাহাড়। এই লাঙ্গল পাহাড়ের একটি হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। রসায়নে পিএইচডি করার জন্য চার বছর ধরে ওখানেই থাকি। এমনিতে আমার বাড়ি কসবায়।
গত ৩ মার্চ যখন ল্যাবে কাজ করছি তখন হঠাৎ ফোন মেসেজ আসে যে মণিপুরের ১৪৪ ধরা জারি হয়েছে। কেন কি কারণে জানি না। শুধু এই টুকু জানতে পারি যে চুরাচানপুরে ঝামেলা হচ্ছে। মেইতি এবং কুকি দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
অশান্তির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এবং ল্যাবে থাকা আমার পাঁচ বন্ধু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাঙ্গল হিলে আমাদের হস্টেলে চলে আসি। ওই এলাকায় কুকিদের বাস বেশি। কোনোদিন চোখের সামনে এই ধরনের পরিস্থিতি দেখিনি। কেমন হয় জানা নেই। শুধু শুনেছি। সেদিন রাত ন'টা নাগাদ যখন হস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছি তখন এক অন্য দৃশ্য চোখে দেখছি। যে পাহাড় দেখলে এতদিন মনে শান্তি আসতো সেই পাহাড় প্রথমবারের জন্য মনে আতঙ্কের জন্ম দিল। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। গাড়ি জ্বলছে। হস্টেলের পাশেই ছিল কুকিদের একটি চার্চ। হঠাৎ করে কয়েকজন কুকি কয়েকটি বাঁশ নিয়ে এসে গোটা রাস্তা ব্যারিকেড করে দেয়, যাতে কেউ সেখানে ঢুকতে না পারে। করোনার সময় যেমন বিভিন্ন এলাকা ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনই। ততক্ষণে এই অশান্তি দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষজন এলাকাবাসী প্রাণভয় ছাদে আশ্রয় নিচ্ছেন। ঐদিন রাতেই হস্টেলের ২০০ মিটারের মধ্যে দু’-চারটে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় মনে হতে থাকে যে হয়তো আর কলকাতায় ফেরা হবে না। হস্টেলে বসেই অধ্যাপক এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরিস্থিতির কথা গাইডকে জানাই। তিনি জানান যে গোটা এলাকায় আধা সেনা এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাই এখন কোনোমতে হস্টেলে রাত কাটাতে হবে।
রাত যত বাড়ছে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ তত বাড়ছে। মাঝখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে আমরা কুকি এবং মিতেই দুই উত্তেজিত জনতার মাঝামাঝি। কিন্তু সিআরপিএফ এবং পুলিশের তৎপরতায় কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যেও গুলির আওয়াজ, পেট্রোল বোমা ছোঁড়ার আওয়াজ কানে আসে।
সেই রাতে ওয়ারডেন্সার এবং আমরা একসঙ্গে রাত জাগলাম। প্রাণ হাতে নিয়ে প্রহর গুনতে থাকলাম কখন এই অভিশপ্ত রাতের অবসান হবে। সকাল হতেই এনআইটি’র পক্ষ থেকে গাড়ি করে হস্টেল থেকে আমাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পাসে প্রত্যেকের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। কিন্তু ক্যাম্পাসে ফিরলেও ভয় কাটেনি। সকাল ১১ টা নাগাদ ক্যাম্পাস থেকেই দেখতে পাচ্ছি যে পেট্রোল বোমা দিয়ে একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটু আগে যে হস্টেল ছেড়ে ক্যাম্পাসে এসেছি সেই হস্টেলের পাশে যত বাড়ি রয়েছে সে বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি সিজার হাসপাতালের পাশে থাকা কুকিদের বাড়িগুলো।
প্রথমদিকে বন্ধুরাই ঠিক করেছিলাম যে বাড়ির লোকেদের কিছু জানাবো না তার কারণ তাদের চিন্তা বাড়বে। কিন্তু খবর চেপে রাখা যায় না সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে মা বাবা যখন খবর পায় তখন তারা ফোনের মাধ্যমে আমাদের খোঁজখবর নেন। বাড়ির লোকের গলা শুনে মনটা শান্ত হলেও মনে একটা ভয় কাজ করতে থাকে, বাড়ি কি ফিরতে পারবো?
ওটা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার জন্য বন্ধ ছিল দোকানপাট খাবারের একটা সমস্যা তখন দেখা দেয়। বেশ কয়েকদিন ভাত ডাল আর চানা খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে।
প্রোপাগান্ডা বা গুজব যে কতটা ভয়ঙ্কর তারও অভিজ্ঞতা হয়েছে এই কয়দিনে। গুজব ছড়ানো হয় যে জলে বিষ মেশানো হচ্ছে একে অপরকে মেরে ফেলার জন্য। সেই গুজবের ধাক্কা আমাদের উপরও পড়েছে। ল্যাবে জল পরীক্ষা করে জল খেতে হয়েছে আমাদের।
কিন্তু এইসবের মধ্যে যাদের কথা না বললে নয় তারা হলেন এনআইটি’র অধ্যাপক থেকে শুরু করে শিক্ষাকর্মীদের কথা। বাইরে আধাসেনা এবং পুলিশ যেমন চেষ্টা চালাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তেমন লাগাতার আমাদের মনে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিলেন অধ্যাপক থেকে শিক্ষা কর্মীরা। একটা পরিবারের সঙ্কট দেখা দিলে গোটা পরিবার যেরকম একসঙ্গে একজোট হয়ে বিপদ মোকাবিলা করে, আমরাও সেই ভাবে একজোট হয়ে সঙ্কটের মোকাবিলা করছিলাম। স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যই রেজিস্টার নিজেদের গাড়ি ব্যবস্থা করেছিলেন। সে গাড়িতে করেই তাঁরা বাড়ি পৌঁছান। তারপর ধীরে ধীরে ভিন রাজ্যের পড়ুয়ারা নিজেদের রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। রাজ্যগুলির পক্ষ থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের রাজ্যের পড়ুয়াদের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিতে থাকে। কিন্তু অন্য রাজ্য নিলেও পশ্চিমবঙ্গের পক্ষ থেকে প্রথমে সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। আমরা বাধ্য হয়ে নবান্নের সঙ্গে যোগাযোগ করি সেই সময় নবান্নের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে বিশেষ বিমানে করে আমাদের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সরকারের সে বিশেষ বিমানে করে প্রায় দু’ তিন দিন পরে, গত বুধবার রাতে কলকাতায় ফিরেছি।
Comments :0