শুভ্রজ্যোতি মজুমদার, শ্রীরামপুর
ভারতের স্বাধীনতার পর ৭২ বছর কেটে গেছে, ইটের পাঁজার অন্তরালে ছাইচাপা আগুনের মতো থেকে গেছে ইটভাটা শ্রমিকদের যন্ত্রণা।
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় বঙ্গের কোনও ইটভাটা হোক বা উত্তর ভারতের ইটভাটা, শ্রমিকদের ওপর ঠিকাদার ও মালিকদের শোষনের ছবিটা একরকম। ইটভাটার দর্মার বেড়া দেওয়া খুপরিতে অর্ধনগ্ন ছেঁড়া জামার মানুষগুলো জানেন সেই শোষণের কথা। কিন্তু মুখ ফুটে বললেই বিপদ। ইটভাটার জমি এক বধ্যভূমির মতো, তার ভেতরে শ্রমিকের যন্ত্রণার কথা চাপা পড়ে যায়। সাংবাদিক হোক বা বাইরের মানুষ, যন্ত্রণার কথা বললে হয় মেরে ভাগিয়ে দেবে, মহিলা হলে সম্ভ্রম লুঠে নেবে। এই হলো দস্তুর।
হুগলি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ইঁটভাটার নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা ইটভাটার শ্রমিকের কথা ছিল এ রকম: এখানে রাত নামে, আর আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে। শৌচকর্মের জন্য উঠলে ফিরতে পারব তো? এখানে ভালো ছোঁয়া বা খারাপ ছোঁয়া আলাদা হয় না। ঠিকাদারের লোলুপ দৃষ্টিতে ছেঁড়া কাপড় ঢেকে সম্ভ্রম রক্ষা করতে হয়। কিন্তু শ্রমিকের কথা বাইরে বলা মানা। বললেই সর্বনাশ।
ইটভাটা শিল্প শ্রমিক নির্ভর। একটি পর্ব মাটি কাটা, তাকে ঢেলে ইটের পর্যায়ে নিয়ে আসা। মাটির তাল ছাঁচে ঢেলে ইঁট বানানো থেকে তপ্ত আগুনে পুড়িয়ে ইট বানানো। তারপর ইট সাজিয়ে রাখা। সব কাজে শ্রমিক লাগে। ইট ভাটা শ্রমিকদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন পথাই শ্রমিক। এরা পাড়নে বসে কাদা মাটি ফর্মায় ফেলে ইট প্রস্তুত করেন। এদের একদল পগমিলে মাটি প্রস্তুত করেন। পগমিল থেকে মাটিকে পাড়নে বয়ে আনে একদল। কাঁচা ইটগুলো পাড়নে এমন ভাবে সাজিয়ে রাখা হয় যাতে তা পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায়।
সব থেকে বেশি শ্রমিক থাকে কাঁচা ইট পাড়ন থেকে মাথায় করে ভাটার ভেতরে নিয়ে যাওয়া এবং একই ভাবে পোড়া লাল ইটকে ভাটার ভেতর থেকে বাইরে এনে সাজিয়ে রাখা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক নানান রকমের কাজ তাঁদের করতে হয়। এদের বলে রেজা। এদের মজুরি সব থেকে কম। সন্তান কোলে করে শতচ্ছিন্ন কাপড়ের গোছায় সন্তানকে বেঁধে ইঁট বয়ে নিয়ে যান এরা।
সংখায় এরা অন্যদের তুলনায় কম। এদের বলা হয় বোঝাই মিস্ত্রি, কিছু থাকেন যাঁরা কয়লার জোগান ঠিক মতো দিয়ে যান, এঁদের বলে কোলম্যান।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ডে খেতের কাজ মিটে গেলে যখন কাজের ঘাটতি হয় ঠিকাদারেরা ধরে আনে শ্রমিকদের। আবার ফসল বোনার সময়ে ঠিকা শ্রমিকেরা তাদের এলাকায় ফিরে যান। মূলত ইটভাটা শ্রমিকদের বড় অংশই পরিযায়ী। তাদের অধিকাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ের না হলে অত্যন্ত গরিব অংশের। প্রত্যন্ত গ্রামে অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান এঁরা। হুগলী জেলার হিন্দমোটর, কোন্নগর, রিষড়া, বৈদ্যবাটি, চুঁচুড়া থেকে বলাগড় পর্যন্ত একাধিক ইটভাটায় এই শ্রমিকরাই কাজ করেন।
অধিকাংশই মজুরি পান না সময়ে। মালিক ও ঠিকাদারেরা মারধর থেকে সব রকমের শোষণ চালায় এঁদের ওপর। মধ্যযুগীয় কায়দায় দাদন বা ঋণের ফাঁসে ধরে এনে একপ্রকার বেগার শ্রমের প্রথা চলে। যদিও আজকাল হুগলী জেলায় সিআইটিইউর নেতৃত্বে আন্দোলনে শ্রমিকদের ওপর এই শোষণ অনেকটাই কমানো গেছে। সরকার শ্রমদপ্তর সব দেখেও নির্বাক। যদিও হুগলী জেলা টালি ও ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়নের ছাতার নিচে শ্রমিকরা এসেছেন বলে তাদের দুর্দশা কিছুটা হলেও মিটেছে। ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট হারে মজুরি আদায় করা গিয়েছে। বেশ কিছু ইটভাটাতে ইউনিয়ন ও ইটভাটা মালিকদের মধ্যে চুক্তি করে মজুরি স্থির করা হয়। তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ইটভাটাগুলিতে শোষণের ধরন বদলায়নি। সেখানেও শ্রমিক সংগঠন মজবুত করার চেষ্টা হচ্ছে, জানান সিআইটিইউ নেতৃবৃন্দ।
ইটভাটা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এবং সিআইটিইউ জেলা সভাপতি মলয় সরকার ও শ্যামল মিত্র জানান হিন্দমোটর, কোন্নগর, রিষড়া, বৈদ্যবাটিতে আবাসন শিল্প গড়ে ওঠায় ইটভাটার সংখ্যা কমছে। কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। আগে উত্তরপাড়া থেকে বৈদ্যবাটি একেকটি ইটভাটায় কম করে ৫০০-৬০০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। আজ জমি হাঙরদের জন্য ধীরে ধীরে হুগলী নদীর তীর দখল হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ইটভাটা সরে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। নগরায়নের বৃদ্ধি নগরায়নের কাঁচামাল ইটকেও প্রভাবিত করছে। জ্বালানির দাম যত বাড়ছে ইটের দামও বাড়ছে। কিন্তু সমস্যায় পড়ছেন শ্রমিকরা। অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে ইটভাটা শ্রমিকরাই সবচেয়ে বঞ্চিত। কিন্তু রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারই এবিষয়ে নীরব।
Comments :0