শেখ সোলেমান ও ডা. ফুয়াদ হালিম
আজ, মুনাফার গ্রাসে মানুষের স্বাস্থ্য। বৈষম্যের বিশ্বায়নে স্বাস্থ্য এখন অর্থকরী ফসল, বাজারী প্রসাধন। আমাদের দেশেই সর্বাধুনিক চিকিৎসাও মিলছে। কিন্তু ফেলো কড়ি মাখো তেল। ‘স্বাস্থ্য’ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক বিষয়। আমাদের দেশ একটি সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। সংবিধানে ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু বিনামূল্যে বা ভরতুকিতে সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাকে সংযুক্ত করে মুনাফা লুটের মৃগয়াক্ষেত্র করে তোলা হচ্ছে। মানুষের করের টাকায় মানুষের পরিষেবা, এখন অতীত। প্রতি বছর প্রায় ৩.৯০ কোটি মানুষ, বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য খরচে (ওষুধ ও চিকিৎসা) সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা অর্থাভাবে ধুঁকছে। এগুলি এখন আর দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য পদক্ষেপের অংশ নয়। জনকল্যাণমূলক কাজ এখন সদিচ্ছার ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোভিড অতিমারী মোকাবিলা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের অধিকাংশ টাকাই পরিষেবা কিনতে ও স্বাস্থ্যবীমা সংস্থা বা কর্পোরেটের (সরকারি ও বেসরকারি) কোষাগারে জমার বন্দোবস্ত হয়েছে। আর্থিক বরাদ্দের অভাবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। আউট সোর্সিং বা রেফারেল কেস বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাপাদাপি, জীবনদায়ী ওষুধের আকাশ ছোঁয়া মূল্য।
প্রতিবছর একাধিকবার ওষুধের দাম বাড়ছে। অপরদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিজ্ঞানের আধুনিক ও ন্যানো প্রযুক্তির সভ্যতার যুগে দাঁড়িয়ে, প্রাচীন চিকিৎসা ও পরম্পরাগত ওষুধ, দেশজ মশলা ও পথ্যের নিদান হাঁকছেন। মানুষ অসহায়।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, পুঁজিবাদ চরম সঙ্কটে। বাজার সম্প্রসারণ ও শক্তি পুনরুদ্ধারে পুঁজিবাদ কল্যাণকর অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা হারিয়েছে। ধান্দার ধনতন্ত্র লুটেরার চেহারায় হাজির। জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ বৈষম্যকে ঢাল করে মানুষের একতা, সৌভ্রাতৃত্ব, বৈচিত্র ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরম্পরা ভাঙতে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি হাতিয়ার করেছে। নয়া উদারনীতির উপরি পাওনা কোভিড অতিমারী দেশের আর্থিক ভিতকে আরও দুর্বল করেছে। দেশের সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে প্রান্তিক ও গরিব মানুষ অনাহারে মরছে। আজ, ভারত প্রায় ১৪৩ কোটি মানব সম্পদশালী রাষ্ট্র। মূলত ১৫-৬৪ বছরের ভারত। কর্ম ও শ্রম শক্তির পাওয়ার হাউস। মাথায় বিজ্ঞান ও হাতে প্রযুক্তি তুলে নেওয়ার অপেক্ষায়। হায়! মুক্ত বাণিজ্যনীতি, বৈষম্যের বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বে দেশের নাগরিকরা কর্মহীন, অসহায়। এই প্রান্তিক, হতদরিদ্র, হতদ্যম, হতাশগ্রস্ত মানুষের সাহস, পরামর্শ প্রদানের জন্য হাজার হাজার আধুনিক, হৃদয়বান, সাহসী, প্রাথমিক প্রকৌশলগত প্রশিক্ষিত আদর্শবান মানুষের স্বেচ্ছাসেবামূলক সহায়তার প্রসারিত হাত প্রয়োজন। যাঁরা হয়ে উঠবেন সময় ও চাহিদার দূত। ‘স্বাস্থ্যবন্ধু’। তাঁরা একক বা দলগতভাবে এই সামাজিক আপৎকালীন সমস্যা থেকে উত্তরণে সম্বল ও সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় আহত সেনাদের চিকিৎসায় ধাত্রী হিসাবে ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেল বা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ডাঃ জাফরুলা চৌধুরির নেতৃত্বে নারী সেবা বাহিনী গঠন এবং তাঁদের ঐতিহাসিক অবদান আজ সর্বজনবিদিত। নর্মান বেথুন, দ্বারকানাথ কোর্টনিস, কামালপাশা বা চে গুয়েভরা প্রমুখ লোকস্বাস্থ্য চিন্তকদের কথাও সবার নিশ্চিত স্মরণে আছে। যাঁরা সমাজ বির্বতনেরও ঐতিহাসিক কারিগর। সময়ের আহ্বানে এঁরা আসেন এবং যুগে যুগে দেশে দেশে এঁরা মানুষের পতাকাবহনকারী সংগ্রাম ও জয় গাঁথা রচনা করেন।
মহামারীর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের রাজ্যে সামাজিক চাহিদাকে সম্বল করে ‘রেড ভলান্টিয়ার বাহিনী’ই ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসেছেন। হাজার হাজার তরতাজা প্রাণ, মন প্রকরণের অলটুরিজম শক্তিকে জারিত করে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। নতুন রক্ত বিপ্লবের জ্বালানি। সময়ের আহ্বানেই সময়ের নেতৃত্ব হয়ে উঠেছিল। পুঁজিবাদ সর্বগ্রাসী, তবু একচেটিয়া আগ্রাসন ও সামাজিক প্রযুক্তি নির্ভর ভার্চুয়াল ব্যক্তিকেন্দ্রিক জগতের মায়াজাল এখনও মূল্যবোধ ও লোকচিন্তার বীজকে নিকেশ করতে পারেনি। ‘রেড ভলান্টিয়ার’ ইতিহাস এবং সংগঠিত সামাজিক শক্তির একটি প্রাথমিক ঝলক মাত্র।
‘স্বাস্থ্যবন্ধু’ কী? তাঁদের কী কাজ?
দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সমূহের সুযোগ-সুবিধা, তথ্যাবলি সরবরাহ (এখনও যতটুকু অবশিষ্ট আছে) এবং যথাযথ পরামর্শ প্রদান করা। আপৎকালীন সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রাথমিক প্রকৌশলগুলি হাতে কলমে প্রয়োগ ও সম্প্রসারিত করা। মুমুর্ষু রোগীর লড়াই করার ক্ষমতা বাড়াতে বা ক্ষতির সম্ভবনা কমাতে বা যাতে রোগী একটু সুবিধা পেতে পারেন এবং চিকিৎসক বা হাসপাতালে পৌঁছনো পর্যন্ত রোগী পরিষেবার সুযোগ দ্রুত গ্রহণ করতে পারেন। সাধারণ মানুষ রোগের প্রাথমিক উৎস, বাহক বা মাধ্যম ও বিস্তার, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রকৌশলগুলি জানলে সিংহভাগ রোগ সংক্রমণ ও বিস্তার সহজেই এড়ানো যাবে। এতে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধী স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামজিক ও পারিবারিক স্বাস্থ্য সূচক/মান উন্নত হবে। এমন দক্ষ ও জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের বাহিনী গঠনের প্রয়াসেই আসে ‘স্বাস্থ্যবন্ধু’র প্রসঙ্গ। কে বা কারা, কিভাবে সমাজে স্বাস্থ্যবন্ধু হিসাবে কাজ করতে পারবেন? যে সকল ব্যক্তি আপৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজনীয় তথ্য জ্ঞান সম্পন্ন, প্রাথমিক চিকিৎসায় সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন, যিনি/যারা দক্ষতার সাথে আকস্মিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত বা অসুস্থ ব্যক্তিকে ডাক্তার আসা বা হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বে জীবন রক্ষায় বা আরোগ্যের পথ সুগম করতে বা আঘাতজনিত অবস্থার যাতে অবনতি না হয় তার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন, এমন ব্যক্তিরা। যেমন, হৃদ-ফুসফুসীয় যন্ত্র পুনঃচালনা করা (CPR), ব্লাড প্রেসার পরিমাপ করা এবং বিপদের ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসকের পরামর্শের নির্দেশনা, পালস রেট পরিমাপ করা, চিকিৎসকের পরামর্শমত অক্সিজেন সিলিন্ডার বা কনসেন্ট্রেটর থেকে প্রয়োজনানুসারে কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ ও সংযোগ প্রদান করা, সাপ ও পশুর কামড়, অস্থি, অস্থিসন্ধি ও স্নায়ুবিক আঘাত, শুষ্ক ও আর্দ্রদাহ, ইত্যাদি সম্পর্কে যাদের প্রাথমিক সাধারণজ্ঞান বা দক্ষতা রয়েছে।
এঁরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামজিক অনুঘটক। যিনি/যাঁরা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল চিহ্নিত করে আপৎকালীন সময়ে দেশ ও রাজ্যে পরিষেবার (যেমন-অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, ব্লাড ব্যাঙ্ক) নম্বর ও তথ্যগুলি সরবরাহ করতে পারবেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল বা নার্সিংহোম বা চিকিৎসকের কাছে গেলে কি কি চিকিৎসা পাওয়া যাবে, তার সঠিক তথ্য প্রদানে সক্ষম হবেন। অঞ্চলের কম্পাউন্ডারের নম্বর, প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা দাই-এর খবর জানবেন বা ব্লাড সংগ্রহের কার্ড সরবরাহ বা অঞ্চলের মানুষের রক্তের বিভাগ ও তালিকা প্রদান করতে পারবেন বা কোনও ওষুধের দোকান দিন ও রাতে খোলা থাকে কিনা বলতে পারবেন। যিনি/যাঁরা জাতীয় অপুষ্টির কারণগুলি সম্পর্কে অবগত এবং উন্নতির পরামর্শ প্রদানে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন হবেন। মানসিক স্বাস্থ্য অবনতির লক্ষণগুলি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান সম্পন্ন হবেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধী স্বাস্থ্য (জল, বাতাস, মশকবাহিত রোগ ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া) সচেতনতা প্রসার কাজের বার্তাবাহক হবেন। মরণোত্তর চক্ষুদান, দেহদান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কলাকোষ অঙ্গদান সম্পর্কে তথ্যপ্রদান ও জনপ্রিয়করণে অগ্রণী সেনাপতি হবেন।
উপরিউক্ত যেকোনও প্রাথমিক জ্ঞান সম্পন্ন ও দক্ষ লোকস্বাস্থ্যচিন্তক মানুষকেই আমরা ‘স্বাস্থ্যবন্ধু’ বলছি। এদের অঞ্চলে অঞ্চলে দলগত প্রবাহমান কাজগুলিকে মালা গেঁথে একটি শারীরিক, মানসিক ও সামজিক পরিপূর্ণ বিকাশমান সমাজ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। সচেতন মানুষই এই বাহিনীর শক্তি। এই বিকাশমান শক্তিবিজ্ঞান সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ও সমাজ পরিবর্তনের মুক্ত বাতাস। আমরা, কোনও পৃথক পেশা ভিত্তিক কাজ শুরুর কথা বলছি না। আমরা, ডিগ্রিধারী বা সমাজ স্বীকৃত ব্যক্তি ছাড়াও অঞ্চলগতভাবে মানবসম্পদের ক্ষমতায়ন ও পরিচিতি চাইছি। যাঁরা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন সমাজসেবী, বা জনস্বাস্থ্য বা জনবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও সাধারণ মানুষকে স্বেচ্ছাশ্রম প্রদানে ইচ্ছুক। তাদের সবাইকেই আহত বা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তির আপৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মে হাতে কলমের প্রকৌশল বা প্রশিক্ষণ প্রদান ও দ্রুত কাজে যুক্ত হওয়ার দক্ষতা/ক্ষমতা প্রদান করতে চাইছি। সাধারণ মানুষ আকস্মিক দুর্ঘটনায় কী করবেন এই ভেবেই আশঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ, তাঁদের জানা নেই, কি করা উচিত বা কিভাবে কাজ শুরু করা উচিত? স্বাস্থ্যবন্ধু প্রশিক্ষণ কর্মসূচী সাধারণ মানুষকে এই দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত করে, দ্রুত কাজে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম। এটি একটি সার্বিক জনউদ্যোগ বা প্রয়াস।
জনবিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলন বর্তমান সময়ের উপযোগী সমাজকল্যাণমূলক কাজের উদ্যোগ প্রাথমিকভাবে শুরু করেছে। রাজ্য ও কয়েকটি জেলায় কর্মশালা হয়েছে, কর্মউদ্যোগ চলছে। বেশ কিছু নিবেদিত প্রাণ এবিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলে কাজে যুক্ত হয়েছেন। এটি একটি বা দুটি সংগঠনের কিছু কর্মী ও সৎ-ইচ্ছা নির্ভর বিষয় নয়। দরকার সমন্বিত জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, ব্যাপক গণউদ্যোগ ও হাজর হাজার স্বেচ্ছাসেবক।
Comments :0