শাসকদলের অন্তর্কলহে রীতিমত সন্ত্রস্ত বগটুইয়ের পাশের পঞ্চায়েত এলাকা মাড়গ্রাম-১। শনিবার রাতের দিকে মাড়গ্রামের ধূলফেলা মোড়ে সদ্য তৃণমূল ছাড়া শেখ সুজাউদ্দিনের দলবল ও এলাকার বর্তমান তৃণমূল প্রধান ভুটু শেখের দলবলের মধ্যে চরম বচসা শুরু হয়। বচসা থেকে তা সংঘর্ষের আকার নেয়। সেই সময় বোমা ছোঁড়া হলে তাতে গুরুতর জখম হয় এলাকার তৃণমূল প্রধানের ভাই লাল্টু (৩৮) শেখ ও অপর তৃণমূল কর্মী নিউটন শেখ (৩৭)। তাদের রামপুরহাট মেডিক্যা ল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা নিউটনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। অপর জখম লাল্টু শেখকে কলকাতা স্থানান্তিরত করা হলে পরে তারও মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার পর রাতেই ফের বগটুইয়ের কায়দায় তৃণমূল বাহিনী তাণ্ডব চালায় বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনদের ঘরবাড়িতে। যদিও এক্ষেত্রে পুলিশ উপস্থিত হলে সেই গন্ডগোল আরও বড় আকার নিতে পারেনি। ঘটনার খবর পেয়ে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা সহ অন্যান্য তৃণমূল নেতারা গিয়েছিলেন এলাকায়।
বিবাদ দীর্ঘদিনের। এলাকায় দখলদারি কার থাকবে সেই নিয়েই দ্বন্দ্ব উঠেছিল চরমে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা তীব্রতা পেয়েছে। এলাকায় দখলদারি থাকা মানেই লুটসর্বস্ব পঞ্চায়েতের বখরার বড় হিস্সাও থাকবে তাদেরই দখলে। এ নিয়ে বীরভূমে মাড়গ্রাম ১নং পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রাক্তন বনাম বর্তমান প্রধানের মধ্যে বিরোধ চরম ওঠে অনেকদিন থেকেই। বর্তমানে প্রাক্তন প্রধানের দলবল এলাকায় দাপট রাখতে বিজেপি ঘুরে কংগ্রেসে যোগ দিলে বিবাদ মাত্রা ছাড়ায়। যার সর্বশেষ পরিণতিতেই মাড়গ্রাম দেখল প্রকাশ্য রাস্তায় বোমাবাজি। যার জেরে মৃত্যু হলো বর্তমান প্রধানের ভাই ও আরও এক তৃণমূল কর্মীর। তৃণমূল এই খুনের পেছনে দলেরই প্রাক্তন প্রধান বর্তমানে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া শেখ সুজাউদ্দিনের দলবলকেই অভিযুক্ত করেছে। যদিও এই সুজাউদ্দিন এখনও কাগজে কলমে মাড়গ্রাম পঞ্চায়েতের ১/১০ সংসদের তৃণমূলের নির্বাচিত সদস্য হিসাবেই বহাল রয়েছেন।
সুজাউদ্দিন সাময়িক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কংগ্রেসের যোগ দিলেও তাকে এলাকার মানুষ এখনও তৃণমূলী বলেই চেনেন। ফলে এই ঘটনাকে সকলেই তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণতি হিসাবেই দেখছেন। মৃত নিউটনের স্ত্রী ফিরদৌসি বিবি বলেন, “আমার স্বামীকে জহির শেখ, আইনাল শেখ, সফিক শেখ, সুজাউদ্দিন শেখরা খুন করেছে। রাত্রি আটটা নাগাদ স্বামীকে বোমা মারার খবর পাই। ঘটনাস্থলেই স্বামীর মৃত্যু হয়। আমি ওদের শাস্তি চাই। ওরা কংগ্রেস করে। আমার স্বামী তৃণমূল করত।’’
ঘটনার জেরে রবিবার সকাল থেকে তৃণমূল কর্মীরা এলাকা তটস্থ করে রাখে। সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহে গেলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্তাও করা হয়েছে। ঘটনা প্রসঙ্গে বীরভূমে পার্টি কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আগে প্রাণে বাঁচার জন্য যারা তৃণমূলে যেত, এখন তারাই বলছে প্রাণে বাঁচার জন্য তৃণমূল ছাড়তে হবে। কারণ তৃণমূলে থাকলে তারা বাঁচতে পারবে না। বগটুই তার প্রমাণ। বখরার ভাগ নিয়েই তো এখন তৃণমূল তৃণমূলকে মারছে। সেই ভাগ বাটোয়ারার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তো মমতা ব্যানার্জিই। কয়লা পাচার, গোরু পাচার, টোল প্লাজার বেআইনি টাকা সব ভাগ করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাই তো ক’দিন আগে বীরভূমে এসে মমতা বলে গিয়েছেন, আগের সিস্টেমেই সব চলবে। অর্থাৎ লুটের রাজত্ব চলবে। সেই লুটের বখরা নিয়ে তৃণমূলের খুনোখুনিও চলবে। রাজ্যে যদি খুনোখুনি বন্ধ করতে তৃণমূলকেই বাদ দিয়ে দিতে হবে।’’
এদিকে মাড়গ্রামে যখন উত্তেজনা চরমে তখনই বদলির নির্দেশ এসেছে বীরভূমের পুলিশ সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠি। মাড়গ্রামে দাঁড়িয়ে বদলির নির্দেশ পাওয়া পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ‘মৃত দু’জনকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া হয়েছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে ১৫ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে সুজাউদ্দিন শেখ সহ মোট ছয় জনকে গ্রেফতার কর হয়েছে। দুই মুল অভিযুক্ত আইনুল শেখ এবং জাহির শেখের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’
এদিকে, বীরভূমের মাড়গ্রামে দুজনের খুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, পুলিশের এসপি’কে নয়, পুলিশের মন্ত্রীকে বদল করুন। এদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সুজন চক্রবর্তী বলেন, ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাসন্তী, ক্যানিং, মাড়গ্রামে মৃত্যুর পর মৃত্যু ঘটছে, বখরার গোলমালে তৃণমূলের হাতে তৃণমূলীরাই খুন হচ্ছে। গোটা রাজ্যটারই এই অবস্থা। পুলিশের ওপরে মানুষের ভরসা থাকবে কেন? পুলিশ শাসকদলের বাহিনীর মতো কাজ করছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুলিশমন্ত্রী। তিনি বগটুইয়ের ঘটনার পরে সেখানে দাঁড়িয়ে পুলিশের ডিজি’কে অস্ত্র উদ্ধার করতে বলেছিলেন। কী হয়েছে? কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বীরভূমে গিয়ে বলেছেন জেলার দায়িত্ব তিনি নিজে নিচ্ছেন। তারপরেই খুন! পুলিশ সুপারকে সরিয়ে কী হবে, পুলিশমন্ত্রীকে সরানো দরকার সবার আগে।
Comments :0