আকাশের বৃষ্টিকে হার মানিয়ে চোখের জল পড়ছে কৃষকদের। এক অকাল বর্ষণের ধাক্কায় গত চব্বিশ ঘণ্টায় দক্ষিণবঙ্গের দু’জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরেকজন সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়াও মাইক্রোফিনান্সের চাপে হুগলীর ধনেখালির আরও একজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যেও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে প্রশাসনের তরফে কৃষক আত্মহত্যার কারণ আড়াল করতে পারিবারিক কলহের গল্প সাজানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাংলার কৃষকদের অর্থনৈতিক জীবন কীরকম সুতোয় ঝুলছে সেটাই যেন দেখিয়ে দিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টি আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন কৃষকের মৃত্যু। শুক্রবার রাতে বর্ধমানের পূর্বস্থলী থানার নিমদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছাতনি উত্তর পাড়ায় আত্মহত্যা করেছেন রূপ সনাতন ঘোষ (৪৫)। তাঁর আলুখেত জলে ডুবে গিয়েছে। অতিবৃষ্টিতে ধানের জমি জলে ডুবে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছেন হুগলীর খানাকুলের কৃষক তরুণ পালুই। চন্দ্রকোণার কৃষক বাপি ঘোষের জমির আলু বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। সঙ্কটজনক তাঁর চিকিৎসা চলছে মেদিনীপুর হাসপাতালে।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিবিমা সহ কৃষক সহায়তা প্রকল্পগুলির মূল্যহীন আশ্বাসকে চোখের সামনে তুলে ধরছে কৃষকদের মৃত্যুর ঘটনা। সদ্য আলু লাগানো খেত নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়ায় হতাশায় শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেছেন রূপ সনাতন ঘোষ। তাঁর বাড়ি পূর্বস্থলী থানার নিমদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছাতনি উত্তরপাড়ায়। শনিবার কালনা মহকুমা হাসপাতালে তাঁর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। মৃতের দাদা অমল ঘোষ জানান, ভাই পাঁচ বিঘে জমিতে চাষ করে সংসার চালাতো। তার বাড়িতে রয়েছে বিধবা মা, স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে। এবছর ধারদেনা করে দু’বিঘা জমিতে উন্নত আলুবীজ দিয়ে চাষ করেছিল। তাছাড়াও ধান, সরষে এবং শসা চাষ ছিল তার। আলুচাষ করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অকালবৃষ্টিতে তার চাষের সমস্ত জমিতে জল জমে যায়। শুক্রবার মাঠ থেকে ঘুরে আসার পর সে হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ তাঁর জমিতে কাটা ধান ভাসছে। সরষের জমিতে জল থইথই করছে। শসার জমিও প্লাবিত। আলুর জমিতে এত জল জমেছে যে, জমি আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
অমল ঘোষ বলেন, শুক্রবার রাতে তেমন কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে ভাই। তারপর কখন যে সে উঠে গিয়ে বাড়ির পাশের একটি আমগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে, কেউ জানতেও পারেনি। গ্রামের কৃষক সমর ঘোষ শনিবার সকালে মাঠের বীজতলা দেখতে গিয়ে রূপ সনাতনের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান।
রূপ সনাতনের মৃত্যুতে গোটা পরিবার ভেসে গেল বলে জানালেন তাঁর প্রতিবেশী উজ্জ্বল ঘোষ এবং শেখ আনোয়ার। কালনা মহকুমাশাসক রূপম আগরওয়াল জানান, ‘‘আমি স্থানীয় প্রধানের মুখে আত্মহত্যার কারণ অন্য শুনেছি। উনি চাষ করতে গিয়ে নয়, পারিবারিক কারণেই আত্মহত্যা করেছেন।’’ আগেও দেখা গিয়েছে, ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটলেই সেখানে সরকারি তদন্তে অন্য রিপোর্ট উঠে আসে। বেশিরভাগ রিপোর্টেই বলা হয় যে, ঋণের দায়ে নয়, কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন পারিবারিক কারণে! সারা ভারত কৃষকসভার পূর্ব বর্ধমান জেলা সভাপতি শুকুল শিকদারের বক্তব্য, রাজ্য সরকার কৃষকদের ব্যাপারে উদাসীন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সরকার নেই। নইলে এই অকাল বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যাকে কেউ পারিবারিক কলহের জের বলতে পারে?
একইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে হুগলী জেলার খানাকুল থানার অন্তর্গত পিলখাঁ কয়েততলা এলাকার বাসিন্দা তরুণ পালুই (৪৭) আত্মঘাতী হয়েছেন। চাষের খেতে ক্ষতির পরিমাণ সহ্য করতে না পেরে তিনিও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। শুক্রবার সকালেই ঘটেছে এই মর্মান্তিক ঘটনা। মৃতের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ধারদেনা করে বেশ কয়েক বিঘা জমিতে ধানচাষ করেছিলেন তরুণ পালুই। গত কয়েকদিন আগে পর্যন্তও সব কিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ নিম্নচাপের বৃষ্টি যেন সব অঙ্কই বদলে দিল। তাঁর প্রায় আট বিঘা জমি জলের তলায় ডুবে রয়েছে। কোনও জমি থেকেই ফসল তুলতে পারবেন না বুঝে যান তিনি। বিপুল ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার রাতে স্ত্রী’র সাথে সামান্য ঝগড়া অশান্তিও হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। আর সকাল হতেই বাড়ির অদূরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হন তরুণ পালুই। তাঁর বন্ধু নিতাই বাড়ুই জানিয়েছেন, ‘‘ধান ডুবে আছে এক হাত জলের তলায়। বৃষ্টিই কেড়ে নিল ওর প্রাণ।’’
মৃত্যু আর আকাশকে দোষ দেওয়া ছাড়া রাজ্যের কৃষকদের সামনে আর অন্য কোনও পথ খোলা রাখেনি সরকার! তাই আলুচাষ করে অসময়ের বৃষ্টিতে সর্বস্বান্ত হওয়ার মুখে ঋণ শোধের চিন্তায় বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন চন্দ্রকোণা থানার কৃষক বাপি ঘোষ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঘাটাল মহকুমা হাসপাতাল থেকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে তাঁকে।
বাপি ঘোষের স্ত্রী ঝুমা ঘোষ মেদিনীপুর হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছেন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দু’দিনই আলুর খেত থেকে জমা জল বের করার জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়ে ছিলেন উনি। বিঘা দেড়েক জমির জল বের হলেও বাকি চার বিঘার আলু লাগানো বীজজমি জলের তলায় থেকে গিয়েছে। শুক্রবার রাত দু’টো নাগাদ বিষ পান করে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করেন তিনি। পুরো ঘর বিষের গন্ধে ভরে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীদের ডেকে স্বামীকে নিয়ে ঘাটাল হাসপাতালে যান তাঁর স্ত্রী। পরিবারের লোকজন জানালেন, নিজের দেড় বিঘা জমি চাষের পাশাপাশি দিনমজুরি করতেন। পরিশ্রমী হওয়ায় প্রতি বছরই পরের জমি চুক্তিতে নিয়ে আলুচাষ করে থাকেন। এবছর পরের চার বিঘা জমি চাষ করার জন্য অগ্রিম টাকা মেটান মহাজনি ঋণ নিয়ে। প্রতিবিঘা জমির ফুরানে চাষের জন্য ৭ হাজার টাকা এবং চাষ উঠলে এক কুইন্টাল আলুর প্রতিশ্রুতিতে চুক্তি হয়। ফুরানে চার বিঘার জমির জন্য ২৮ হাজার টাকা অগ্রিম সহ সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ প্রায় পৌনে দু’লক্ষ টাকা।
এদিকে, মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় শনিবার সকালে ধনেখালি থানা এলাকার বেলমুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাবনান গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ মালিক (৩০) গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ঋণের কিস্তির টাকা শোধ না করতে পারায় বাড়িতে কয়েকদিন ধরেই অশান্তি চলছিল। তার জেরেই এই আত্মহত্যা বলে মনে করছেন গ্রামবাসীরা। আত্মঘাতী দিলীপ মালিকের পরিবারে বাবা, মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনি এক বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এলাকায় ভদ্র ও সজ্জন বলে পরিচিত ছিলেন দিলীপ মালিক। তাঁর বাবার কিছু চাষের জমি আছে, সেখানেই চাষের কাজ করতেন। এবারে ধানচাষ করে লাভজনক দর পাননি। যার ফলে ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় চিন্তায় ছিলেন। এর আগে দু’সপ্তাহের কিস্তি মেটাতে পারেনি। শনিবার ছিল কিস্তি দেওয়ার তৃতীয় সপ্তাহ। বাড়িতে টাকা নেই, তার ওপর কিস্তি দিতে হবে, এই নিয়ে স্ত্রী’র সঙ্গে সকাল থেকেই ঝামেলা চলছিল। পরিবারের লোক হঠাৎই দেখতে পান আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
এই সব কৃষক পরিবারে দৈনন্দিন কথা কাটাকাটি, সাংসারিক সঙ্কটের পেছনে রয়েছে দারিদ্র, ঋণভার, উপার্জন আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি। এই বাস্তবতাকে যারা আড়াল করতে চায় তাঁদের নৃশংসতা অকাল বর্ষণের চেয়েও ভয়ঙ্কর, মন্তব্য করেছেন কৃষকসভার নেতারা।
Rain Farmer Suicide
চব্বিশ ঘণ্টায় রাজ্যে ৩ কৃষক আত্মঘাতী
×
Comments :0