পাঁচ দশক আগের জরুরি অবস্থা জারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইদানীং নরেন্দ্র মোদীর সরকার অতিমাত্রায় সক্রিয় এবং মুখর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত লোকসভা নির্বাচনে ৬০টি আসন খুইয়ে এবং সরকার গড়ার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে তৃতীয় বারের জন্য কোনোমতে সরকার গঠনের পর থেকেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ তীব্র করেছে জরুরি অবস্থা নিয়ে। এমনকি এখন থেকে প্রতি বছর জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিন ২৫ জুনকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসাবে সরকারিভাবে পালনের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, যে আরএসএস-বিজেপি সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আচমকা গণতন্ত্রপ্রেমী ও সংবিধান দরদি হয়ে উঠেছে মোদী জমানার গত দশ বছর ধরে জরুরি অবস্থা নিয়ে কোনও বাক্য ব্যয় করতে দেখা যায়নি। তার আগের চার দশকেও জরুরি অবস্থা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বরং তৎকালীন আরএসএস প্রধান বালাসাহেব দেওরস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দু’ -দু’বার চিঠি লিখে আপসের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর ২০ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে আজকের বিজেপি নেতাদের পূর্বসূরিদের জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। তারও অনেক আগে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তৎকালীন আরএসএস-জনসঙ্ঘ নেতারাও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হবার পর মুচলেকা দিয়ে, ব্রিটিশদের বিরোধিতা না করার এবং সাহায্য করার অঙ্গীকার করে বন্দি জীবন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে উজ্জ্বল নাম সাভারকার এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। ধর্মের চৌহদ্দি থেকে হিন্দুত্বকে টেনে হিঁচড়ে রাজনীতির আঙিনায় নামিয়ে এনে যারা হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ঘৃণার রাজনৈতিক তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান সাভারকার।
ধর্মান্ধ বা ধর্মীয় মৌলবাদী অথবা ভিন্ন ধর্মে ঘৃণা পোষণকারীরা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের পূজারি হতে পারে না। গণতন্ত্রে সব ধর্মের সমানাধিকার। ধর্ম হিসাবে কোনও ধর্মের প্রাধান্য গণতন্ত্রে স্বীকৃত নয়। তাই গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পরের পরিপূরক। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র অসম্পূর্ণ, সঙ্কীর্ণতা দোষে দুষ্ট। যারা ভারতের সংবিধানের এবং ভারতীয় সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের মুখে গণতন্ত্র ভূতের মুখে রামনামের মত। গণতন্ত্রে তাদের নীতিগত ও আদর্শগতভাবে বিশ্বাস নেই। শুধু ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে মানুষকে বোকা বানানোর জন্য গণতান্ত্রিকতার ভান করে।
দশ বছর ধরে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর নির্মমভাবে বুলডোজার চালিয়ে ধর্মীয় অহিষ্ণুতার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এখন গণতন্ত্রের ভেক ধারণ করছে। সংবিধান নিয়ে রাতারাতি মুখর হয়ে উঠছে। তাই জরুরি অবস্থা নিয়ে বাজার গরম করেতে চাইছে। হিন্দুত্ববাদী অতি দক্ষিণপন্থীদের চরিত্র এমনটাই হয়ে থাকে। ক্ষমতা ও আধিপত্যের স্বার্থ এদের এতটাই প্রবল যে দরকার পড়লে নিজেদের অতীত, ইতিহাস, ঐতিহ্যকেও অস্বীকার করে, ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। গত দশ বছর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদকেও স্বৈরাচারের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছিল। কার্যত আলোচনা ছাড়া একতরফাভাবে বিল পাশ করিয়ে, আইন সংশোধন করে মানুষের অধিকারকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। দমনমূলক নীতি প্রণয়ন হয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রের দমনপীড়ন জারি করা হয়েছে। সংবিধান আর গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে কার্যত তালিবানি শাসন কায়েম করা হয়েছে। মানুষ এই স্বৈরাচারী গণতন্ত্রবিরোধী, সংবিধানের হত্যকারীদের চিনে ফেলেছেন। এবারের নির্বাচনে তার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়েছে। তাই ভয় পেয়ে মোদীরা এখন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গণতন্ত্রের-সংবিধানের ভেক ধরতে চাইছে। জরুরি অবস্থা নিয়ে হঠাৎ এত মাতামাতি তারই সম্প্রসারিত অঙ্গ।
Comments :0