গত ৯ জুন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাচনে অতি দক্ষিণপন্থীরা ভাল ফলাফল করে। EU নির্বাচনের ফলাফলের ধাক্কায় ফ্রান্স-সহ একাধিক দেশের সরকার টলমল করতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের বিপর্যয়কর ফলাফলের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। ম্যাক্রোঁর রেনেসাঁ পার্টি যে উদারপন্থী জোটের অন্তর্ভুক্ত, তারা মাত্র ১৩টি আসন জিতেছে, যেখানে মেরিন লে পেনের কট্টর দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি ৩০টি আসন পেয়েছে।
অবসরের বয়স বাড়ানো, অভিবাসন নির্দেশিকা কঠোর করা এবং ইউক্রেনে ফরাসি সৈন্য পাঠানোর প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেওয়া বেশ কয়েকটি বিতর্কিত নীতির কারণে ম্যাক্রোঁর সরকার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। অতিরিক্তভাবে, প্রশাসন বিদেশের অঞ্চলগুলির সাথে খারাপ আচরণের জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে, যার মধ্যে অতি সম্প্রতি নিউ ক্যালেডোনিয়ায় গণ বিক্ষোভের উপর নিপীড়নও যুক্ত রয়েছে। বর্তমান জনমত সমীক্ষায় ন্যাশনাল র্যালিতে প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট পড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ম্যাক্রোঁর রেনেসাঁর চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশি, যা ২০ শতাংশের সামান্য নিচে। এই পরিস্থিতিতে, ন্যাশনাল র্যালি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে না পারলেও, এখনও তাদের অভিবাসন বিরোধী এবং সুরক্ষা এজেন্ডা ছড়াবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকবে ফ্রান্সে।
এই পরিস্থিতিতে লে পেন এবং ন্যাশনাল র্যালির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী জর্ডান বারদেলা অন্যান্য ডানপন্থী এবং মধ্য-ডানপন্থী দলগুলোর সাথে তাদের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরিক জেমুরের কট্টর ডানপন্থী দল রিকনকোয়েস্ট এবং গললিস্ট রক্ষণশীল দল দ্য রিপাবলিকানদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এই আপাত হতাশাজনক পরিস্থিতিকে দুর্দান্তভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছেন ফরাসী বামপন্থীরা।
EU নির্বাচনে অতিদক্ষিণপন্থীদের বিপুল সাফল্যের খবর আসতেই প্যারিস-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমে আসেন হাজার হাজার বামপন্থী কর্মী, সমর্থক, ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। তাঁরা অতিদক্ষিণপন্থী উত্থানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। ঘোষণা করেন, যে কোনও মূল্যে ফ্রান্সকে রক্ষা করবেন ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে। স্বতঃস্ফূর্ত এই বিক্ষোভ ফিরিয়ে আনে বহু দশক আগের পপুলার ফ্রন্টের স্মৃতি। এই পরিস্থিতিতে নজিরবিহীনভাবে ফ্রান্সের প্রধান চারটি বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা করেছে। যাবতীয় বিভেদ, তিক্ততা সরিয়ে রেখে তৈরি হয়েছে একুশ শতকের পপুলার ফ্রন্ট। ৫৭৭টি আসনেই জোটবদ্ধভাবে লড়াই করবে এই নতুন ফ্রন্ট।
২৭৯টি আসনে লড়বে জাঁ-লুক মেলেশোঁর নেতৃত্বাধীন র্যাডিকাল বামপন্থী দল 'বিদ্রোহী ফ্রান্স' বা LFI, ৫০টি আসনে লড়বে ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি, ১৭৫টি আসনে লড়বেন সোস্যালিস্টরা এবং ৯২টি আসনে প্রার্থী দেবে দ্য গ্রিনস।
নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা তো সময়ই বলবে। কিন্তু খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে এই বামপন্থী পপুলার ফ্রন্ট। ৩০%+ ভোট পেয়ে রুখে দিতে পারে অতিদক্ষিণপন্থার ঝড়। গত নির্বাচনেও দারুণ ফল করেছিলেন মেলেশোঁ। ইউরোপীয় নির্বাচনের পর থেকে মধ্য-বাম ও বাম দলগুলো লি পেনকে ক্ষমতা দখল থেকে বিরত রাখতে এবং ম্যাক্রোঁর কিছু নীতি পাল্টাতে একটি যৌথ প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা করছে তারই ফলশ্রুতি হল এই বামপন্থী জোট। শুক্রবার, ১৪ই জুন, সোশ্যালিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, গ্রিনস এবং ফ্রান্স আনবোউড (লা ফ্রান্স ইনসৌমিস, এলএফআই) নিউ পপুলার ফ্রন্টের (নুভাউ ফ্রন্ট পপুলায়ার, এনএফপি) কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যৌথ প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রয়েছে অবসরের বয়স হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান খাদ্য ও জ্বালানির দাম রোধ করা। এলএফআইয়ের ম্যানন অব্রির মতে, জোটের মূল উদ্দেশ্য হল ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা’’।
ন্যাশনাল র্যালির জনপ্রিয়তা বিবেচনায় বামপন্থীদের ঐক্য গড়ে তোলা একটি ইতিবাচক উন্নয়ন, যদিও এই যৌথ কর্মসূচি নিয়ে স্পষ্টতই অনেক দর কষাকষি হয়েছে। ইউক্রেন ও প্যালেস্তাইন যুদ্ধ নিয়ে মতবিরোধের কারণে মধ্য বাম প্ল্যাটফর্মগুলোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। যদিও এলএফআই শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে সমর্থন করেছে, অন্যরা আরও মূলধারার ইউরোপীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে।
এনএফপি গঠনের সময়, দলের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন যে তাদের অগ্রাধিকার হবে ‘‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফ্রান্সের জন্য শান্তির পথে’’ ফিরিয়ে আনা, যার মধ্যে পুতিনের আগ্রাসী যুদ্ধের মুখে ইউক্রেনকে সমর্থন করা এবং গাজায় চলমান গণহত্যার মুখে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বর্তমানে, ঐক্যবদ্ধ বাম যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রায় ২৮-৩০% ভোট থাকলেও তা লে পেনের দলকে ছাপিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তবে প্রত্যাশিতভাবে তা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
Comments :0