LALGARH INSAF JATRA

রাত ৯টায় লালগড় অপেক্ষা করছে সুবর্ণরেখার

রাজ্য

রাত ৯টায় ইনসাফ যাত্রা ঘিরে জনতার ভিড় লালগড়ে। ছবি: শ্যামল মজুমদার

চন্দন দাস: লালগড়

 রাত ৯ টা। লালগড় অপেক্ষায়। ইনসাফ যাত্রার। আসলে সুবর্ণরেখার। 
মৃদু শীতের আমেজ বাতাসে। এসআই চকের চায়ের দোকান সাড়ে ৮টায় ঝাঁপ বন্ধ করার তোড়জোর চলে। সোমবার সেই দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু লোক। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও প্রায় শ'তিনেক গ্রামবাসী। একজন এগিয়ে এলেন। কান, মাথা ঢাকা টুপিতে। চশমার নিচে উদগ্রীব চোখ। বয়স প্রায়
ষাট। কিছুক্ষণ জরিপ করে বুঝলেন পদযাত্রীদের খবর আমার কাছে আছে। এগিয়ে এসে বললেন, "মীনাক্ষীরা কতদূর?ছাত্র যুবদের পদযাত্রা তখন নেতাইয়ের সভা শেষ করে লালগড়ের দিকে এগচ্ছে। সামনে এক ছাত্র। ফুলহাতা সোয়েটার। মাঙ্কি ক্যাপে মুখের অনেকটা ঢাকা। পায়ে অবশ্য হাওয়াই চটি। ডানহাতে প্ল্যাকার্ড, 'শালকু সরেনের খুনীদের  বিচার চাই।"
লালগড় জেগে আছে। শালকুর তল্লাট অপেক্ষায় আছে। ইনসাফ যাত্রা পা রাখছে সেই ভেঙে, জ্বালিয়ে দেওয়া পার্টি অফিসের সামনে দিয়ে নেতাই পেরিয়ে। 
অনেক শহীদদের মাটিতে মিথ্যা মামলা, তৃণমূল-মাওবাদীদের হামলা,বিজেপি’র চক্রান্তে যারা লালগড়, বেলাটিকরি, ধরমপুর, রামগড়, নেপুরাকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছেন, তাঁদের জন্য সোমবারের রাত সুবর্ণরেখা।
মঙ্গলবার আদালতে শুনানি আছে বলে যাঁরা থাকতে পারবেন না পদযাত্রীদের পাশে, তাঁদের একজন আক্ষেপ জানিয়ে শক্ত মুঠোয় হাত চেপে ধরে বললেন, "ছেলেমেয়েগুলোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। কী পরিশ্রমটাই না করছে!"
অণুজ পান্ডের চোখের কোণা কী চিকচিক করছে? লালগড় কী বালিতে পথ হারানো কাঁসাইয়ে প্লাবন টের পাচ্ছে? 
'আগে রাম পরে বাম' স্লোগান এখানে হেরেছে। এখানেই, কংসাবতীর অদূরে এই নেপুরাতেই 'ইনসাফ যাত্রা'কে স্বাগত জানালো ঝাড়গ্রাম। 
শীত নেই। কিন্তু বিকাল ফুরাচ্ছে আগে। খেতে দ্রুত ধান কাটা চলছে, অকাল বৃষ্টির আশঙ্কায়। গ্রামের অনেক পুরুষ ভিন জেলায় চলে গেছেন ধান কাটতে। সোমবার তখন সরষের হলুদ ফুলে  সূর্যের শেষ আলো পড়ছিল। নিম আর আকাশমণির উঁচু ডালের পাতায় সন্ধ্যার রেশ। মাটির এজমালি উঠোনে উকিল সরেনের মত শিশুরা দাপাচ্ছে। তখন বাঁকুড়া ছেড়ে ঝাড়গ্রামে পা রাখলেন পদযাত্রীরা। মহিলাদের একদল তৈরি ছিলেন ফুল, মালা নিয়ে। তবে অনেকেই দূরে দূরে ছিলেন অপেক্ষায়। তাঁদের হাতে ফুল ছিল না। তবে চোখে ছিল খুশি, আশা --"একবার ছেলেমেয়েগুলোকে দেখব। অতদূর থেকে আসছে। আমাদের এলাকায় ওদের মিছিল। দেখবো বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি।" রাতের রান্না বসানোর সময় পিছিয়ে দিয়ে নেপুরার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী মহিলা এই ভাবেই নিজের আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে দিলেন। 
এদিন নেপুরা থেকে লালগড় -দীর্ঘ পথে অনেক জায়গায় পদযাত্রীদের দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে। অন্ধকারে পেরোতে হয়েছে মজে যাওয়া কাঁসাই। এমনকি আজও যেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি কথা বামপন্থীদের পক্ষে তুলনামূলক কঠিন, সেই নেতাইয়ে পদযাত্রীরা সভা করেছেন। সভা হয়েছে লালগড়েও।
তবু নেপুরার তাৎপর্য অন্য জায়গায়। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে এখানে ১৩টি আসনের ৮টিতে জিতে পঞ্চায়েত গঠন করেছিল বিজেপি।চণ্ডী করণের মত নেতারা তখন তৃণমূলের চক্রান্তে জেলবন্দি। অনেক বামপন্থী নেতা, কর্মীর উপর মামলা। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসাবে সেই নির্বাচনেই স্লোগান উপস্থিত হয়েছিল --'আগে রাম পরে বাম।' সেই স্লোগানের ধাক্কায় বিজেপির জয়। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর সময় নিয়েছেন গ্রামবাসীরা। ২০২৩-র নির্বাচনে বিজেপি ১৩ টি আসনেই লড়ল। তৃণমূল অন্তত চারটি আসনে জালিয়াতি করল ভোটে, গণনায়। তবু ১৩টি আসনের ৬টিতে সিপিআই (এম) -কে জিতিয়ে দিলেন গ্রামবাসীরা। ততদিনে পার্টির অনেক নেতাই জেল থেকে বেরিয়ে, নিজেদের অঞ্চলে ফিরে গ্রামবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। 
ফল? বিজেপি উধাও। একটি আসন বেশি দখল করে তৃণমূল পঞ্চায়েত পেয়েছে। তবে গ্রামে গ্রামে ফিরে এসেছে পুরানো চেনা ঝান্ডা। লাল ঝান্ডা। 
কেন এই রূপান্তর? মীনাক্ষী মুখার্জি সিঁজুয়ায় গ্রামের মন্দিরের সামনে কিছুটা খোলা এলাকায় পদযাত্রার কারণ এবং ব্রিগেড সমাবেশের দাবি ব্যাখ্যা করছেন, তখন সন্ধ্যার মুগ্ধ জনতার জমায়েতের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যুবক কিঙ্কর বললেন, "যারা ভেবেছিলেন যে বিজেপি তৃণমূলকে রুখবে। পঞ্চায়েতে ওদের জেতার কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল এরাও চোর। তৃণমূলের মতোই। আমাদের পাত্তাই দেয় না। যখন সব জেল থেকে বেরিয়ে এলো, আমরা সাহস পেয়ে গেলাম। বিজেপি ফুটে গেল।"
পদযাত্রায় পা মেলানো জঙ্গলমহলের এই যুবকের কথাই কী ফুটে উঠল মীনাক্ষী মুখার্জির কথায়? কিছুতেই দূরে সরে যেতে রাজি না হওয়া গ্রামবাসীদের সামনে ডিওয়াইএফআই-র রাজ্য সম্পাদক বললেন, "চোর আর দাঙ্গাবাজ, এই দুইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। একদিকে তৃণমূল আর বিজেপি। আর একদিকে খেটে খাওয়া মানুষ, কাজের দাবি নিয়ে লড়াকু যুবক, পড়তে চাওয়া ছাত্রছাত্রীরা। আছেন কৃষক, খেতমজুর, মহিলারা। আমাদের পদযাত্রা তাঁদের দাবি নিয়ে। চোর আর দাঙ্গাবাজদের তাড়াতেই হবে। ব্রিগেড থেকে সেই লড়াইয়ের আর এক পর্যায়ের আহ্বান জানানো হবে। লড়াই ছাড়া জয় আসবে না। লড়াইয়ের পথেই এগতে চাই আমরা। আপনারা আসুন। সবাই একসাথে লড়াই হবে। "
মীনাক্ষী মুখার্জি ছাড়াও এদিন পদযাত্রায় ছিলেন ধ্রুবজ্যোতি সাহা, হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য, কলতান দাশগুপ্ত, ইব্রাহিম আলি, সনাতন দেবসিংহ, সুকুমার বারিক প্রমুখ যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব। ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মধুজা সেন রায়। ছিলেন পুলিনবিহারী বাস্কে, পার্থ যাদব, ফুল্লরা মণ্ডল, অনুজ পান্ডে, খলিল আহমেদ, চণ্ডী করণ, ডালিম পান্ডে প্রমুখ গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব। 
নেতাইয়ে সভার পর পদযাত্রা হয় লালগড় এসআই চক পর্যন্ত।


ছবি: শ্যামল মজুমদার

Comments :0

Login to leave a comment