গল্প | মুক্তধারা
দোলনা
সৌরভ দত্ত
পড়ুয়া নেই।স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাবে মন ভালো নেই যতীন মাস্টারের।নির্দেশিকা এসে গেছে।তাকে বদলি হয়ে যেতে হবে ভিন জেলার পানবয়েড়া গ্রামে। বদলির চিঠি পেয়েছে গতকাল ।নিউজ পেপার খবরটা পড়তে পড়তে চোখে জল চলে এল। বন্ধ হচ্ছে পঁচিশটা প্রাইমারি স্কুল। শীতের দুপুর জানলার ফাঁক দিয়ে কেমন বেমানান ভাবে এসে পড়েছে তার চেয়ারের উপর। বোর্ডের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেক আশা নিয়ে এই বাণীপুর বিদ্যাপীঠে এসেছিল। প্রথমে চল্লিশ থেকে ছাত্র সংখ্যা কমতে কমতে এখন সাকুল্যে সাতজন দাঁড়িয়েছে।অয়ন গোস্বামী,কৃষ্ণা পাড়ুই, সুনীল হাঁসদারা মাস্টার মশাইয়ের সাথে পড়ার ফাঁকে গাছ বসায়।গাছের গোড়ায় জল দেয়। স্কুলের পাশের বকুল গাছে দোল খায়। যতীন সরকার ওদের হাতে ধরে আঁকতে শেখায় ।লিখতে শেখায়।ওরা হ্রস্ব-ই দিয়ে হাঁস আঁকে। অনেক একে-চন্দ্র বলতে পারত না।ভুল বুলি আওড়াত এক চন্দ। এখন ওরা ভালোভাবে লিখতে-পড়তে পারে। কিন্তু গ্রামের এই ছোট্ট স্কুলটা উঠে যাবে। ওখানে হয়ত প্রোমোটিং হয়ে লজ তৈরি হবে।না হলে স্থানীয় পঞ্চায়েত এর দাক্ষিণ্যে বি এস কে সেন্টার কিংবা কমিউনিটি টয়লেট হবে।একদিন সমাজবিরোধীদের আখড়া হয়ে উঠবে না তো স্কুল চত্ত্বর!এসবই ভাবিত করে যতীনকে। কিন্তু,যতীন স্যারকে চলে যেতে হবে অন্যত্র। গাঁয়ের বাচ্চাদের আর কেউ চেনাবে না রামধনুর রঙ–‘বেনিআসহকলা’।১৯১০ এ স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বে তৈরি হয়েছিল স্কুলটা। স্কুলের ভিজিটার্স রেজিষ্টারে কত খ্যাতনামাদের সাক্ষর সত্যেন বোস, শরৎচন্দ্র, দীনেশচন্দ্র সেন।কান পাতলে শোনা যায় পিকেটিং এর আওয়াজ।আলমারি থেকে পুরনো খাতা খুলে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ওল্টাতে থাকে সে।কত ইতিহাস পলে-অনুপলে জড়িয়ে।স্কুলের পাশেই রয়েছে পাল-সেন যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।তার চাতালে বসে পড়ুয়ারা কাটাকুটি খেলে।
শিক্ষকের চোখটা ভারী। ছলছল করে। আজ শেষ ক্লাস বোর্ড অ আ এর পর কি লিখবে ভেবে পায় না যতীন স্যার!সব কেমন গুলিয়ে যায়। সে দেখতে থাকে নোটন নোটন পায়রা গুলো উড়ে যাচ্ছে আকাশে । আঙুল তুলে দেখায় ছাত্রদের ।অয়ন ,কৃষ্ণা,সুশীলরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে পায়রার ডানা ঝাপটানি।ছুটির ঘন্টা বাজে। যতীন স্যার বাইকে স্টার্ট দেন।ধুলোর কুণ্ডলী পাক খেতে থাকে।অয়ন,কৃষ্ণা,সুনীলদের চোখের সামনে থেকে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যান যতীন স্যার।আর কোনদিন ফিরবেন না সাধের ক্লাসরুমে।বকুল গাছে বাঁধা দোলনাটা ফাঁকা দুলতে থাকে…
Comments :0