চন্দন দাস: বারুইপুর
‘মেঘের গায়ে মেঘ জমেছে কলকাতাতে/ সুচিত্রা সেন কেমন আছেন এই বর্ষাতে?’ এই প্রশ্ন কবিতায় উঠে এসেছিল। আসতে পারেই। সুচিত্রা সেন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট নয়, যে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে কারও পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে দেবে।
সোমবার রেমাল ঝড়ে আর বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো সৃজন ভট্টাচার্যর কলমে সুচিত্রা সেন কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছিল। তা গানও হয়েছিল। ‘এবং কয়েকজন’-এর গিটারে আর কণ্ঠে ফুটে উঠেছিলেন মহানায়িকা। শুরুতে যাদবপুর, টালিগঞ্জের মতো মহানগরের হৃদয়ের কথা মনে হলেও যত গানটির সঙ্গে বৃষ্টির বিকাল, সন্ধ্যায় হাঁটা যাবে, দেখা যাবে গানটি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে দূরান্তে। প্রমাণ? গানটির শেষ লাইন। কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে রাজ্যের দূরান্তের সমস্যা জর্জরিত মানুষের গভীর, সুপ্ত ভালোবাসার একটিই বলে দিয়েছে শেষ লাইনটি— ‘সুচিত্রা সেন আজও আসেন আমার ঘুমে।’
যে মননে আঁধির কেন্দ্রীয় চরিত্র মেঘমল্লার হয়ে আসেন, সেই মগজে সাদা জুতো পড়া সওকত মোল্লা? খুবই বিরক্তিকর! গিটারের তারে সাবলীল আঙুলে ভোট লুট আটকানোর পাটিগণিত, জ্যামিতি? এককথায়— যাচ্ছেতাই! কিন্তু ভোট তাই-ই। অন্তত মমতা-শাসনে, সওকত-আরাবুলের মাটিতে ব্যাপারটা এতটাই জঘন্য।
কিন্তু বাস্তব তাই। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের একটি অংশ ভাঙড় বিধানসভা। গত বিধানসভা নির্বাচনে এখানে বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের সমর্থনে আইএসএফ জিতেছিল। এবার আইএসএফ লোকসভা নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করলে সওকত মোল্লা-আরাবুল ইসলামদের পরাজিত করা সম্ভব। ভাঙড়ের গ্রাম বলছে—তৃণমূলের ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকত মোল্লার বাহিনীর ভোটলুটের চেষ্টা রুখতে মরিয়া তাঁরা।
শুধু ভাঙড়ে নয়, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের আরও কিছু এলাকায় ভোটলুটের চেষ্টা করবে তৃণমূল, সেই আশঙ্কা ইতিমধ্যেই দেখা গেছে। ১০৯নং ওয়ার্ডের শহীদ স্মৃতি কলোনির সাম্প্রতিক ঘটনা তারই প্রমাণ। সিপিআই(এম) প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তৃণমূল। পার্টিকর্মীকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরেছে। মিথ্যা অভিযোগে মামলা সাজিয়েছে। কেন সিপিআই(এম)’কে দেওয়াল লিখতে দেওয়া হয়েছে, এই ‘অপরাধে’ এক প্রৌঢ়াকে হুমকি দিয়েছে তৃণমূল বন্দুক হাতে। পাটুলিতে তৃণমূলের আক্রমণের শিকার হয়েছেন এক অসুস্থ পার্টিকর্মী।
এই সবই বিজেপি’র ‘ইসবার চারশো পার’ প্রচারের টান কমতে থাকার পর!
গত লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুরে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল বিজেপি। তৃণমূল বিরোধী ভোটের একটি অংশ বিজেপি’তে যাওয়ায় লাভ হয়েছিল মমতা ব্যানার্জির। এবার ‘মোদী হাওয়া’ দেশজুড়েই চুপসেছে। তৃণমূলের ভোটলুট, ভয় দেখানোর প্রয়াসও যাদবপুরে তাই বেড়েছে। তৃণমূলের যাবতীয় প্রচার হয়ে উঠেছে সিপিআই(এম) বিরোধী। সেই ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী সম্পর্কে কুৎসাও বাদ রাখছে না তারা। অবশ্য বামফ্রন্টের প্রচার চলেছে, চলছে মূলত কর্মসংস্থান, তৃণমূলের দুর্নীতি, বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে।
যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের ৭টি বিধানসভার দু’টি, যাদবপুর এবং টালিগঞ্জ কলকাতা কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে। অর্থাৎ মহানগরের অংশ। কিন্তু বাকি পাঁচটি বিধানসভার প্রতিটি কলকাতার কাছে। ইতিহাস বলছে সোনারপুর, বারুইপুর, ভাঙড়, কালিকাপুরের মতো যে এলাকাগুলি জমি আন্দোলনের দুর্দান্ত ঘাঁটি ছিল, বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পরশপাথরে সেই এলাকাগুলিতে নব্যধনীরা মাথা তুলেছে। মধ্যবিত্ত বিকশিত হয়েছে। শহর বেড়েছে। বাজার বেড়েছে। সেই বাজারে মন্দা, অস্থিরতা। কাজের অভাব যাদবপুরেও।
এই কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। ছাত্র আন্দোলনের নেতা বক্তা এবং গায়কও। তাঁদের একটি ব্যান্ড আছে— ‘এবং কয়েকজন।’ পরশপাথর পছন্দের ব্যান্ড যাঁর, সেই সৃজন ভট্টাচার্য সোনারপুরের এক বাসিন্দার গুণগ্রাহী। সৃজনের কথায়,‘‘সলিল চৌধুরি আমাদের সৃষ্টির অনুপ্রেরণা।’’ গত ১৫বছরে ৩টি লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে। কিন্তু কোনও প্রার্থীকেই দ্বিতীয়বার দাঁড় করাতে পারেননি মমতা ব্যানার্জি। কবীর সুমন, সুগত বসু এবং সর্বশেষ মিমি চক্রবর্তী— যাদবপুরে তৃণমূলের প্রতীকে জিতেছেন। কিন্তু পরের বার আর প্রার্থী হননি। আসলে কেউই দাঁড়াতে চাননি দ্বিতীয়বার। তৃণমূলের নেতাদের ‘খালি খাও খাও..’র সঙ্গে কেউই নিজেদের মানিয়ে চলতে পারেননি, অভিযোগ কিছুটা এমনই। কবীর সুমন তা নাটকীয়ভাবে তা প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। বাকিরা নিঃশব্দে সরে পড়েছেন। সম্প্রতি বারুইপুরের সমাবেশে নিজের দলের গত পাঁচ বছরের সাংসদের নাম না করে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি বলেছেন,‘‘গত পাঁচ বছর আপনারা সার্ভিস পাননি, এবারে পাবেন।’’
মিমি ‘সার্ভিস’ দিতে পারেননি। কিন্তু সংসদে সিএএ বিল পেশের দিন অনুপস্থিত থেকে বিজেপি’কে বার্তা দেওয়ার দলীয় ‘সার্ভিস’ তিনি বিলক্ষণ দিয়েছেন। দলের এবারের প্রার্থী সায়নী ঘোষের প্রতি মমতা ব্যানার্জির আস্থার কারণ, চাকরির নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ধৃত তৃণমূলের এক নেতার সঙ্গে যাদবপুরের এবারের তৃণমূল প্রার্থীর খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক।
সেই চুরি যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে সর্বত্র। ১০৯নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা সহ বাইপাস লাগোয়া ওয়ার্ডগুলিতে জমি, প্রমোটারদের থেকে কাটমানি আদায় তৃণমূলের সোনার খনি। সোনারপুর, বারুইপুরেও তৃণমূল নেতাদের কামাইয়ের একটি বড় ক্ষেত্র জমি, নির্মাণ-সিন্ডিকেট, প্রমোটারদের থেকে কাটমানি। অটো কিংবা টোটো— তৃণমূলকে টাকা না দিলে কোনও কিছুর চাকাই ঘোরে না এই লোকসভার বেশিরভাগ এলাকায়। তাছাড়া আছে বিভিন্ন ভাতা থেকে তৃণমূলীদের কমিশন নেওয়া। তা গ্রামাঞ্চলেও যেমন শহরাঞ্চলেও তাই।
তৃণমূলের লুটের রাজত্ব যাদবপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। যা এবারের নির্বাচনে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বারুইপুর থেকে শিয়ালদহের একটি ব্যাগের দোকানে কাজ করতে ট্রেনে ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ করেন বেবি হালদার। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলকে ভোট দেব কোন দুঃখে? সবকটা চোর। এদের না তাড়াতে পারলে কিছু হবে না। সব খেয়ে নেবে এরা।’’ কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা তো দিচ্ছে? বেবি হালদারের পাশে পাশে হাঁটছিলেন রীনা মণ্ডল আর অসীম মণ্ডল। রীনা কাজ করেন আর একটু দূরে, শ্যামবাজারে। বাস ধরবেন শিয়ালদহ থেকে। তিনি বলে উঠলেন,‘‘ভাণ্ডার দেয় তো কী হলো? সরকার দেবে না তো কে দেবে? ওসব ওরা বোঝাচ্ছে। কোনওদিন শুনেছেন সরকারের ভাতা প্রকল্প বন্ধ হয়েছে? টাকা ওদের ২০২৬ পর্যন্ত দিয়ে যেতেই হবে। বন্ধ করতে পারবে না।’’
বিজেপি প্রার্থী করেছে এক স্বয়ংসেবককে, অনির্বাণ গাঙ্গুলি। যাদবপুর বিধানসভার বিধায়কও এক স্বয়ংসেবক, তবে তিনি তৃণমূলের প্রতীকে জিতেছিলেন। বিজেপি’র প্রার্থীকে দেখা গেছে কম, কিন্তু বিজেপি’র দেদার টাকা খরচের যাবতীয় চিহ্ন ছড়িয়ে আছে তাদের প্রচারে— তৃণমূল অনেকটা তাদের ‘সাফল্য’র উপর নির্ভর করে আছে।
Srijan Jadavpur
গানে বর্ষার সুচিত্রা সেন আর বিজেপি’র আশায় থাকা সওকতদের অঙ্ক
×
Comments :0