অনিন্দ্য হাজরা, ঝাড়গ্রাম
“বলছি শুনুন, ওসব বাজে কথা। আমরা বলছি, লালগড় এলাকায় কম করে তিনটে পঞ্চায়েত জিতবে বামপন্থীরা। ব্লক ধরলে সংখ্যাটা আরো বাড়বে। আমরা পঞ্চায়েতের দায়িত্বে এলে, সমস্ত মানুষ, যাদের বার্ধক্য ভাতা বিধবা ভাতা পাওয়ার কথা কিংবা লক্ষীর ভান্ডার পাওয়ার কথা, সবাই সবটা পাবে। তার জন্য এক পয়সা কাট মানি কাউকে দিতে হবে না।”
বিনপুর-১ ব্লকের লালগড় বাজারের সামনে সিপিআই(এম)’র দপ্তর। এখানেই সে সময়ে লালগড় লোকাল কমিটির এই দপ্তর জ্বালিয়ে দিয়ে তাণ্ডব নৃত্য নেচেছিল মাওবাদী-তৃণমূল জোট। সেই দপ্তরের সামনেই দাঁড়িয়ে বললেন অলক কান্তি দাস, সিপিআই(এম)'র লালগড় এরিয়া কমিটির সম্পাদক।
চলতি পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়া ইস্তক, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তাঁর দল এখন প্রচারে নেমেছে যে তৃণমূল হারলেই লক্ষীর ভান্ডার সহজ সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে। তা নিয়েই প্রশ্ন করা হয়েছিল লালগড়ের দাসকে।
চলতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনপুরের দুটি ব্লকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী সিপিআই(এম)।
২০২১ সালের পর থেকে নিয়মিত কাজ শুরু হয়েছে লালগড় পার্টি অফিসে। এলাকার মানুষও ভয় কাটিয়ে অফিসে আসছেন, এসে বসছেন।
লালগড় অফিসে বুধবার ছিলেন সিপিআই(এম) ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির সম্পাদক প্রদীপ সরকার। নির্বাচনী বৈঠকের ফাঁকে তিনি জানালেন, বিনপুর-১ নম্বর ব্লকের লালগড়, ধরমপুর, বৈতা, নেপুরা এবং বেলাটিকরি পঞ্চায়েতে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তাঁরা। বিনপুর-২ নম্বর ব্লকের বাঁশপাহাড়ি, শিলদা,হাঁড়দা, ভুলাভেদা, সান্দাপাড়া, ভেলাইডিহার মতো পঞ্চায়েতেও জেতার অবস্থায় রয়েছে সিপিআই(এম)। বাকি পঞ্চায়েতগুলিতেও জোরদার লড়াই হবে।
বিনপুর-১'র বৈতা থেকে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হয়েছেন রোহিত চালক। এই পঞ্চায়েতের সমস্ত বুথেই রয়েছে সিপিআই(এম) প্রার্থী।
রোহিত চালক বলছেন, ‘‘২০০৮ সালের পর ২০২৩ সাল। বলা চলে পাহাড় ডিঙিয়েছি আমরা। মাওবাদী তৃণমূল জোটের সন্ত্রাসের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল বৈতা পঞ্চায়েত এলাকা।’’
রোহিত জানাচ্ছেন তাঁরই পাড়ার বাসিন্দা জহর চালককে কুমারপাড়া প্রাথমিক স্কুলের ছাদে গুলি করে হত্যা করেছিল মাওবাদীরা। কালিজুড়া গ্রামের সেই যুবক বাকি গ্রামবাসীদের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল প্রাথমিক স্কুলের ছাদে। প্রথমে স্কুলের ছাদ লক্ষ্য করে হাত কামান থেকে গোলা ছোড়া হয়। বিস্ফোরণের শব্দে, ছাদে শুয়ে থাকা সিপিআই(এম) কর্মীরা উঠে দাঁড়ান। তখন তাঁদের মাথা লক্ষ্য করে একে ফর্টিসেভেন রাইফেল থেকে ব্রাশ ফায়ারিং করে মাওবাদী। সেইগুলিতেই প্রাণ হারান জহর চালক।
শুধু জহর চালকই নয়। বৈতা পঞ্চায়েতের বালিজুড়া গ্রামের শ্রীচরণ চালককে মেদিনীপুরগামী বাস থেকে টেনে নামিয়ে খুন করা হয়। শ্রীচরণ চালকের দেহ আজও মেলেনি। বৈতা পঞ্চায়েতেরই রবি ডাং। বৈতা বাজার থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে পুঁতে দেওয়া হয় কংসাবতীর চড়ে। তিনদিন পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে দেহ।
সন্ত্রাসের এই বদ্ধ ভূমিতে কিভাবে সম্ভব হল নতুন করে পথচলা?
লালগড় বাজার থেকে বৈতা যাওয়ার পথে তারই খানিক বিবরণ দিলে রোহিত চালক। দীর্ঘ সময়। প্রায় ১৬ কিলোমিটার। অধিকাংশ জায়গায় রাস্তার কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। আগামী বর্ষায় রাস্তার কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। পথের একটা বড় অংশ গিয়েছে কংসাবতী নদীর পাড় ঘেঁষে। নদী বাঁধের বরাদ্দ টাকা গিয়েছে তৃণমূলের পকেটে। আসছে বর্ষায়, কংসাবতীতে প্লাবন হলে নদীর পেটে যাবে এই রাস্তার একটা বড় অংশ। তারই মাঝে মাঝে, বৃন্দাবনপুর, গহমি প্রভৃতি ক্ষুদ্র কিংবা অতি ক্ষুদ্র জনপদেও দুই ফুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে লাল ঝান্ডা। সংখ্যা এবং আকার, দুই এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে।
রোহিত জানাচ্ছেন, ‘‘আমরা দীর্ঘদিন ঘরছাড়া ছিলাম। ঘরে ফেরার পরেও চাপা সন্ত্রাস ছিল। গাঁয়ের মানুষ চট করে মিশতে চাইত না আমাদের সঙ্গে। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। সামাজিকভাবে যখন যার যেরকম প্রয়োজন, তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তার মাঝেই তৃণমূল ঝড় এলো, বিজেপি ঝড় এলো। খুঁটি ধরে হলেও আমরা কোনরকমে টিকে রইলাম। এখন অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ ফের আমাদের ঝাণ্ডার নিচে ভিড় করছে।’’
মঙ্গলবার থেকে এলাকায় এলাকায় শুরু হয়েছে দেওয়াল লিখন। বুধবার গামারিয়া বড়কলা এলাকায় চোখে পড়ল তেমনি দেওয়াল লিখনের। দেওয়াল লিখছেন এই এলাকা থেকে জেলা পরিষদের সিপিআই(এম) প্রার্থী জিতেন্দ্রনাথ মাহাতো।
তাঁকে ঘিরে ভিড় করে রয়েছে অন্তত ৩০ জন যুবকের একটি বাহিনী। সবাই ওই গ্রামেরই বাসিন্দা। এঁদের মধ্যে অনেকে কিছুদিন আগেও সক্রিয়ভাবে বিজেপি করতেন।
বিজেপি ছেড়ে সিপিআই(এম)-এ যোগ দিলেন কেন? অলক চালকের কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আবাস কিংবা ১০০ দিনের কাজের জন্য একেকটা গ্রাম পঞ্চায়েতে কম করে ১০ কোটি টাকা এসেছে। এর 'ম্যাক্সিমাম' টাই তো চুরি হয়েছে। যারা দিল্লিতে বসে রয়েছে তাঁরা জানতো না কিছু? আর তাছাড়া বড় ফুল করলে জোড়া ফুলের জিততে সুবিধা হবে।’’
পঞ্চায়েতের দুর্নীতি ছাড়াও লাল ঝাণ্ডার প্রচারে উঠে আসছে অনুন্নয়নের প্রসঙ্গ। প্রায় গোটা ঝাড়গ্রাম জেলায় পানীয় জলের জন্য এখনো ভরসা সাবমার্সিবল পাম্প। লালগড়ের কাছে কংসাবতীর উপর সেতু হলেও, অধিকাংশ জায়গায় নদী পেরোতে হয় পায়ে হেঁটে। দুনিয়া উল্টে গেলেও অ্যাম্বুলেন্স সহ কোন রকমের চার চাকা নিয়ে নদী পেরনো যায় না। বাইক পার করতে ভরসা বাঁশের সাঁকো। বালি লুট কিংবা আদিবাসী ল্যাম্পস দুর্নীতি তো রয়েছেই ।
এরই মাঝে পুরনো সংযোগ ঝালিয়ে নিয়ে প্রবল ভাবে লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এসেছে লাল ঝান্ডা। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব আশাবাদী, ২০০৮ সালের পর লাল মাটির এই দেশে ফের একবার নজর কাড়া ফল হতে চলেছে।
Comments :0