সুদীপ্ত বসু: দমদম
এখানে ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ নির্বাচনী লড়াইয়েরই অংশ।
বিটি রোড ধরে এগনো এই দমদম লোকসভা কেন্দ্রে বামপন্থা এখনও শিল্পীর হাতে নিখুঁত তাঁতের কাপড়।
এখানে বিমান মাটি ছোঁয় অহরহ, আর শাসকের দাপটে লকডাউন পর্বেও বিমানবন্দর থেকে ছাঁটাই হয় ঠিকা শ্রমিক। নগরায়নের অনিবার্য প্রভাবে এখানেও জীবনবোধ পালটাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। তবুও জীবনের উপান্তে এসেও আশি পেরনো প্রৌঢ়া এখানে লাল ঝান্ডার প্রচার মিছিল দেখে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেন মলিন হয়ে যাওয়া আঁচলে।
স্বাধনীতার আগেও বেলঘরিয়ায় সেই ৩৮ সালে শ্রমিকের আন্দোলন, চটকলের গেটে লাল নিশান দেখেছে— কমিউনিস্ট আন্দোলনের সেই বহমান স্রোতধারাই দমদমের ঐতিহ্য। সেখানেই তৃণমূল আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া উইমকো কারখানার শ্রমিকরা শুনেছেন মন্ত্রীর বক্রোক্তি, ‘কারখানা তো বন্ধ হবেই, যা দিচ্ছে মালিক, নিয়ে কেটে পড়ুন।’ এখানেই কাজ হারানো শ্রমিক শুনেছেন শাসক দলের সাংসদের নির্বিকার ঔদ্ধত্যের ভাষা, ‘ডাকব্যাকের মতো একটি কারখানা থাকল কী থাকল না তা দিয়ে কিছু হয় না, ওই কটা ভোট আমার লাগবে না’।
দমদম এই ঔদ্ধত্যের অবসান চায়। ‘দমদমে একটা স্বাভাবিক ঐতিহ্য আছে, বড় ইতিহাস আছে। সেটা রক্ষা করার দায় আমাদের। এখানকার সাংসদ গোপন ক্যামেরার সামনে হাত পেতে ঘুষ নেন। এই কেন্দ্রের ছয়টি পৌরসভার নিয়োগ দুর্নীতিতে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত চলছে, এখানকার এক বিধায়ক দুর্নীতিতে জেল খেটে এসেছে। একের পর এক কারখানা বন্ধ। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে চাইছে মানুষ। এখানকার মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিশেছে আমাদের প্রচার’ দিনভর প্রচারের ব্যস্ততার মাঝেই বলছিলেন দমদমে কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী।
গত প্রায় দু’মাসের বেশি সময় ধরে গোটা লোকসভার সাতটি বিধানসভা এলাকার ১৭৯২টি বুথ এলাকাই চষে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি প্রচার কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। যত সময় এগিয়েছে, পানিহাটি থেকে খড়দহ, কামারহাটি থেকে উত্তর দমদমের বিস্তীর্ণ প্রান্তে মানুষের স্বাভাবিক উপলব্ধি এই কেন্দ্রের নির্বাচনী বিন্যাস বেবাক বদলে দিয়েছে।
সেই উপলব্ধির নির্যাসই এদিন বৃষ্টিভেজা অন্ধকার হয়ে আসা দুপুর বেলায় কাজ হারানো দক্ষিণেশ্বরের উইমকোর শ্রমিক প্রদ্যুৎ কর্মকারের গলায়, ‘একটার পর একটা কারখানা এখানে বন্ধ হয়ে গেছে তৃণমূলের আমলে। আগের শ্রমমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসুর কাছে গেছিলাম কারখানা বন্ধের পরে, কারখানা তো চিরজীবন খোলা থাকে না, বন্ধ হবেই। কাজ হারিয়ে এখন রাস্তায় ফেরি করে কত শ্রমিক। এদের হাত থেকে রেহাই চাই, দমদম সুজন চক্রবর্তীকেই চাই’।
‘এই সুদীর্ঘ রাস্তাজুড়ে ভিড় লেগেছে, কারখানার ছুটির ভিড়। সারা বাংলার বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্র এই রাস্তা। গঙ্গার তীরে তীরে, রেললাইনের ধারে ধারে অসংখ্য কারখানার ইমারত...এবড়ে খেবড়ো, বাঁকাচোরা, দোমড়ানো সুদীর্ঘ শিল্পশহর...যেন একটা মাইলের পর মাইল কালো পটের ওপরে কালো ভারী পোস্টারকালারের থ্যাবড়া ব্রাশে ছবি আঁকা হয়েছে...’ পাঁচের দশকে সমরেশ বসুর সেই ‘বি টি রোডের ধারে’ উপন্যাসের বিবরণ। বদলে গেছে অনেকটাই। ‘বাংলার বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্র’ এখন খণ্ডহরে পরিণত।
তৃণমূল সরকারের আসার পর থেকেই বিস্তীর্ণ এই তল্লাটে স্রেফ কারখানা বন্ধ হওয়ার গল্প। ব্রিটানিয়ার, ডাকব্যাক এখন বন্ধ কারখানার তকমায়। চোখের সামনে লুট হয়ে যাচ্ছে জিনিসপত্র। ইন্ডিয়া ফয়েলসেরও সমস্ত মালপত্র চুরি হচ্ছে দিনে-রাতে। ২০১১ সালের পর বন্ধ হয়েছে প্রিয়া বিস্কুট, খড়দহের এস্যাব, কামারহাটির উইমকো, কৃষ্ণা রাবার অ্যাসোসিয়েটেড পেপারের মতো একের পর এক কারখানা। ঝোপ, জঙ্গল, যন্ত্রাংশ চুরি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা জেশপ কারখানা চত্বর। বিধানসভায় জেশপ অধিগ্রহণ বিল পাশ হয়েছিল। সবুজ আবির উড়েছিল। ‘অধিগ্রহণ’ ঘোষণার মাত্র চার মাসের মধ্যেই লিকুইডেশনে চলে যায় জেশপ। পাশেই এইচএমভি। এখানে আবার শাসক দলের বাহিনী তালিকা হাতে শ্রমিকদের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল ভিআরএস নেওয়ার জন্য, ‘ফোর্সিবল রিটায়ারমেন্ট স্কিম’!
পানিহাটির তিন নম্বর কলোনি থেকেই কিছু দূরের ডাকব্যাক কারখানা! এখন সেখানে গোডাউন। নারদের ঘুষ নেওয়ার মতো এই পানিহাটিতেই ‘ওপেন সিক্রেট’ ডাকব্যাক গোটাতে রীতিমতো মালিকপক্ষের হয়েই ভাড়া খেটেছেন সৌগত রায়। কাজ হারানো কর্মচারীদের কথায়, ‘কারখানার ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন সৌগত রায়, লেক গার্ডেন্সে গিয়েছিলাম সৌগত রায়ের বাড়িতে কথা বলতে। বলেছিলেন, বিটি রোডের ওপরে ১০০টা কারখানা বন্ধ, এটা হলে না হয় ১০১ হবে’!
বন্ধ হয়ে যাওয়া হরবনসলাল মালহোত্রার ব্লেড কারখানার শ্রমিক গণেশ চক্রবর্তী বলছিলেন, ১১’র তৃণমূল সরকার আসার পরেই বেড়ে যায় মালিকের রোয়াব। নিজাম প্যালেসে সৌগত রায়ের কাছে গিয়েছিলাম, বলেছিলেন কোম্পানি লস হচ্ছে, কেন চালাবে কারখানা। এরা সাংসদ নাকি দালাল?’ পনেরো বছরের সাংসদ এখানে শাসক দলের কাছেও ‘অস্বস্তি’!
তৃণমূলের হাতে নাগরিক পরিষেবার হাল কী হতে পারে তা রোজ জানান দিচ্ছে পানিহাটি পৌর এলাকা। নোংরাতম পৌরসভার তকমাও জুটেছে। পানীয় জলের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে মহিলারা। আবার বরাহনগর পৌরসভা, সেখানে চাপানো হয়েছে জঞ্জাল কর। কুড়ি টাকা, একশো টাকার। কলকাতা শহরে পার্কিং ফিস কর্পোরেশনের দশ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা করলে মিডিয়া ডেকে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভে ফেটে পড়া অথচ এখানোই জঞ্জাল সরানোর জন্য কর চাপানো হয়েছে।
এখানেই কামারহাটি, পানিহাটি, বরাহনগর, দমদম, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদমের মতো পৌরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির কেঁচো খুঁড়তেই পৌরসভার নিয়োগ দুর্নীতির কেউটে বেরিয়ে এসেছে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বেআইনি নিয়োগ, সিবিআই তল্লাশি, জেরা। পরিণামে তৃণমূল বিধায়কের বেমালুম বিজেপি-তে চলে যাওয়া, উত্তর কলকাতায় প্রার্থী হওয়া। আবার বারাকপুরের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক ‘হিন্দুত্বের ভরসায়’ চলে এসেছেন দমদমে বিজেপি’র প্রার্থী হয়ে।
এটা বাস্তব এখানে একবার জয়ী হয়েছিল বিজেপি। তবে বিভাজনের রাজনীতি শিকড় গাড়তে পারেনি এখানে। শিখ নিধনই হোক কিংবা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে, দমদম দেখেছিল লাল ঝান্ডা হাতে রাত পাহারা। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকাও, দেশজোড়া এই লড়াইয়ের ডাক তাই এখানে আরও সোচ্চার।
সিপিআই(এম) নেতা মানস মুখার্জির কথায়, দমদমের ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার সম্ভব, এই ভোটেই তার প্রতিফলন দেখবে রাজ্যবাসী। মানুষ এখানে শাসক দলের প্রতি বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। মানুষ দেখেছে এখানে শাসক তৃণমূলকে হারাতে গেলে সিপিআই(এম), বামপন্থীরাই তা পারবে। বিজেপি এখানে বিক্রি হয়ে যাবে। এখানে দেশ বাঁচানোর লড়াই নিজের ঘর বাঁচানোর লড়াইয়ের শামিল।’
Comments :0