বিশ্বজিৎ দাস, গুয়াহাটি
এখনও থমথমে মণিপুরের পরিস্থিতি। হু হু করে বাড়ছে সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যাও। রাজ্য ছেড়ে ইতিমধ্যেই পালিয়ে গেছেন লক্ষাধিক মানুষ। সেনার তরফে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত তেত্রিশ হাজারের বেশি আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। ‘দেখা মাত্র গুলির’ নির্দেশ দেওয়ার পর শুক্রবার চুরাচাঁদপুর জেলায় সেনার গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে দুই মহিলা রয়েছেন। তাঁদের একজন নার্স বলে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ চুরাচাঁদপুর জেলায় আটকে পড়া শতাধিক মেইথেই সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্ধার করে আনার সময় পথ আগলে দাঁড়ায় কয়েকশো আদিবাসী মানুষ। তখন তাদের হটাতে শূন্যে গুলি ছোঁড়ে সেনা জওয়ানরা। তাতে চারজনের গায়ে গুলি লাগে। রাজ্যে জাতি সংঘর্ষে শনিবার পর্যন্ত ৫৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই দেহগুলি রাজ্যের তিনটি হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে ইম্ফলের রিমস হাসপাতালে ২৩টি, জেএনআইএমএস হাসপাতালে ১৫টি ও চুরাচাঁদপুর জেলা হাসপাতালের মর্গে ২০ টি লাশ পড়ে আছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় মণিপুরে নিট পরীক্ষা বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রবিবার সারা দেশে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা। এবারের নিট পরীক্ষায় মণিপুরের ৮ হাজার ৭৫১ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। ইম্ফলের মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও উখরুলের ধনমানজুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে আটকে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের উদ্ধার করে ইম্ফলের আসাম রাইফেলসের ক্যাম্পে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মণিপুরের জাতি সংঘর্ষের ফলে এরাজ্যে পড়তে আসা অন্য রাজ্যেরও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আটকা পড়েছে। এরমধ্যে মিজোরাম, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের কয়েকশো ছাত্রছাত্রীকে নিজ নিজ রাজ্য সরকার শনিবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। তবে অন্য রাজ্যের আরও পড়ুয়া এখনও মণিপুরে আটকে আছে।
টানা কারফিউর ফলে মণিপুরে খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। খাবার ও পানীয় জলের তীব্র হাহাকার । গত ২৮ এপ্রিল চুরাচাঁদপুর জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থল জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার পরপরই চুরাচাঁদপুর জেলায় কারফিউ ও আরও কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারা বলবৎ করে প্রশাসন। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই বাইরের রাজ্য থেকে আসা খাদ্য বোঝাই লরি মণিপুরে ঢোকেনি। এরপর গত ৩ মের ঘটনার পর গোটা রাজ্যে কারফিউ জারি করে রাজ্য সরকার। ফলে গত আট দিন ধরে খাদ্য বোঝাই লরি কিংবা তেলের ট্যাঙ্কার, রান্নার গ্যাসের লরি কোনোকিছুই মণিপুরে ঢোকেনি। এছাড়া দোকানপাটও বন্ধ। খাবারের সঙ্কটের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের সঙ্কট তীব্র আকার নিয়েছে। রাজধানী ইম্ফল শহরে হাতেগোনা দুই-তিনটি পাম্পে রেশনিং ব্যাবস্থায় পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে। তার জন্য পাম্পে দীর্ঘ লাইন।
পাশাপাশি সংঘর্ষ কবলিত এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। রাজ্যের বড় বড় সরকারি দপ্তরে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। চুরাচাঁদপুরে রাজ্যের মিনি সচিবালয়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে পাশের রাজ্য আসাম, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামেও পালিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এক কাপড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছেন মানুষ। তাদের সঙ্গে না আছে খাবার, না আছে জল, ওষুধ। শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের অবস্থা করুণ। আসামের কাছাড় জেলার লক্ষ্মীপুর মহকুমায় শনিবার পর্যন্ত সতেরো হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর। এঁরা মণিপুরের জিরিবাম জেলা থেকে পালিয়ে এসেছেন। লক্ষ্মীপুরের আটটি স্কুলে শিবির করে তাদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাদাগাদি করে রাত কাটাচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। শনিবার ত্রাণ শিবিরগুলি পরিদর্শন করে এবং জেলা প্রশাসনের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণের দাবি জানিয়েছে ডিওয়াইএফআই’র প্রতিনিধি দল ।
রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় শনিবার সর্বদলীয় বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং। সর্বদলীয় বৈঠকের দাবি দু’দিন আগেই জানিয়েছিল সিপিআই(এম)। বৈঠকে কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, বিজেপি, এনপিপি, এনপিএফ, শিবসেনা, জেডি(ইউ), আপ দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আরও সেনা মোতায়েন করা, সংঘর্ষ-পীড়িত এলাকায় আটকে পড়া মানুষকে দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করা, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ত্রাণ শিবিরগুলিতে পর্যাপ্ত খাবার পৌঁছে দেওয়া, গুজব বন্ধে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রভৃতি সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। এদিন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও বৈঠক করেন বীরেন সিং।
মাত্র দেড় বছর আগে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মোদী-শাহ থেকে শুরু করে এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মণিপুরে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। কিন্তু মণিপুর যখন জ্বলছে, প্রতিদিন মানুষ মরছে, প্রাণ বাঁচাতে ভিন রাজ্যে পালাচ্ছে, তখন মোদী-শাহ তো দূর, একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এখনও পর্যন্ত মণিপুরে আসেননি। মোদী-শাহরা অবশ্য এখন ব্যস্ত কর্ণাটকে গৈরিক শাসন জিইয়ে রাখার লড়াইয়ে। বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক সম্বিত পাত্রকে ইম্ফল পাঠিয়ে দায় সেরেছেন নরেন্দ্র মোদী। সংঘর্ষ বিধ্বস্ত মণিপুরে কোনো সরকারি প্রতিনিধিকে না পাঠিয়ে দলীয় প্রতিনিধিকে পাঠানো নিয়ে মোদী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
Comments :0