ম্যাচের বয়স তখন ৮৫ মিনিট। গোলশূন্য ম্যাচ। ততক্ষণে ডেডলক ভাঙতে গিয়ে ঘাম ছুটে গিয়েছে মোহনবাগানের। ভুবনেশ্বরের মাঠে যে ক’জন মোহন সমর্থক গিয়েছিলেন, তাঁরা আশা-আশঙ্কার দোলাচলে ভুগতে শুরু করেছেন। সাইডলাইনে দাঁড়ানো মোহনবাগান কোচ জুয়ান ফেরান্ডোর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। তাঁর পরিকল্পনাই কাজে দেয়নি। মোহন সমর্থকদের মনে প্রশ্ন ঘোরা ফেরা করছিল তবে কী পয়েন্ট নষ্ট করবে দল?
হঠাৎই ম্যাচে পট পরিবর্তন। সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়ার ডিফেন্ডার ব্রেন্ডন হ্যামিল। ডানদিক থেকে অফ দ্য বল মুভ করলেন তিনি। একেবারে ফাঁকায়। আনমার্কড। মাঝমাঠে এক সতীর্থের কাছ থেকে বল পান সাহাল আব্দুল সামাদ। আগে মোহনবাগান দলটার চালিকাশক্তি ছিলেন জনি কাউকো। এবার সেই জায়গাটা কিছুটা ভরাট করেছেন সাহাল। তাঁর পা থেকে বেরলো একটা ডিফেন্স চেরা থ্রু । তাতেই হায়দরাবাদের রক্ষণ ফালাফালা হয়ে গেল। একেবারে ঠিকানা লেখা পাস (বিশ্ব ফুটবলে এই ধরনের পাস দিতে দেখা যায় বেলজিয়াম ও ম্যাঞ্চেস্টার সিটির তারকা মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনেকে)। বলটা পেয়েই সজোরে শট হামিলের। বল জড়িয়ে যায় জালে। ডিফেন্ডার হয়েও স্ট্রাইকারের ভূমিকা পালন করলেন তিনি। হামিল যেভাবে গোলটা করলেন, যা সাধারণত করতে দেখা যায় দিমিত্রি পেত্রাটোস ও মনবীর সিংহদের। তাঁদের অনুপস্থিতিতে হামিল গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়ে ছুটে গেলেন গ্যালারি সামনে। দশর্কদের চাগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে সতীর্থদের ভালোবাসায় মিশে গেলেন তিনি।
ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে ফের গোল মোহনবাগানের। গোলদাতা আশিস রাই। তাঁর গোলটাও দৃষ্টিনন্দন। হুগো বুমোসের ভলি হায়দরাবাদের এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে ফেরত আসে, গোলের গন্ধ পেয়ে ফাঁকায় দাড়ানো আশিস বক্সের মধ্যে থেকে শট জাল কাঁপিয়ে দেন, তাতেই তিন পয়েন্ট নিশ্চিত হয়ে যায় মোহনবাগানের। বিপক্ষের গোলকিপার গুরমিত ঝাঁপালেও, নাগাল পাননি তিনি। পুরনো দলের বিরুদ্ধে গোল করে নির্লিপ্ত থাকলেন আশিস। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ২-০ গোলে মোহনবাগান হারিয়ে দিল হায়দরাবাদকে। আইএসএলের ইতিহাসে প্রথম দল হিসাবে প্রথম পাঁচটা ম্যাচ জিতল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। নতুন নজির আনন্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হাসলেন জুয়ান। পাঁচ ম্যাচে পনেরো পয়েন্ট নিয়ে ওডিশার ঘরের মাঠে তাঁদের টপকে চার থেকে তৃতীয় স্থানে উঠে এল সবুজ মেরুন শিবির।
আইএসএলে মোহনবাগান অপরাজিত থাকলেও, এএফসি কাপের শেষ দু’টি ম্যাচে হারের পর হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিল। তার উপর দলটা চোট-আঘাতে জর্জরিত ছিল। এএফসি কাপ থেকে বিদায়ের পর, দমবন্ধ করা পরিবেশ ছিল বাগানে। শীতের আমেজে এদিনের জয়ে বাগানে কড়ি থেকে নতুন ফুল ফুটবে বলাই যায়।
এদিন জুয়ান প্রথম একাদশে একাধিক পরিবর্তন করেন। পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বদলে ফেলেন। আর্মান্দো সাদিকুকে বসিয়ে বিপক্ষ রক্ষণকে চাপে ফেলতে শুরু করান কিয়ান নাসিরিকে। গ্লেন মার্টিন্সের জায়গায় থাপা। কিন্তু তাতে প্রথমার্ধে কোনও ফল মেলেনি। হায়দরাবাদ নিজেদের বল ধরে রেখে খেলছিল, প্রতি আক্রমণের চেষ্টা করা ছাড়া গতি ছিল না বাগানের। ১৫ মিনিটে সাহালের পাস থেকে কামিন্স শট করেন, বল পেয়ে যান কিয়ান। তিনি কাজের কাজ কিছু করতে পারেননি। ২৮ মিনিটে লিস্টন কোলাসো ফ্রিকিক ক্রসবারে লেগে না ফিরলে, তখনই এগিয়ে যেতে পারত মোহনবাগান। ৩৫ মিনিটের হায়দরাবাদের জো নোলেসের প্রচেষ্টা কয়েক ইঞ্চির জন্য ব্যর্থ হয়। বিরতির আগে দু’দলই একাধিকবার গোলের চেষ্টা করেও, গোলমুখ খুলতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগানকে অনেক বেশি প্রো-অ্যাক্টিভ লেগেছে। লিস্টন, বুমোস, সাহালরা সম্মিলিত প্রচেষ্টা আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছিল। তবুও বারেবারে আটকে যাচ্ছিল। কোনওভাবেই কিছু হচ্ছিল না। ৮০ মিনিটে ব্যক্তিগত মুনশিয়ানায় তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি বুমোস। তবে পাঁচ মিনিট বাদেই এগিয়ে যায় মোহনবাগান। গোল করেন হ্যামিল। ৯৬ মিনিটে আশিসের গোলে জয় সবুজ মেরুনের। এএফসিতে কলিঙ্গতে ছন্দ নষ্ট হয়েছিল। সেখানেই জিতে নতুন লক্ষ্যের দিকে একধাপ এগিয়ে গেল। আগামী ৬ ডিসেম্বর ওডিশা এফসি’র বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ফের আইএসএলের ম্যাচ মোহনবাগানের।
Comments :0