Ayodhya Ram Temple

দশ টাকাতেই মুখে হাসি রামলালার

জাতীয়

‘রামলালা তো অ্যায়সে নেহি থে!’ জায়ান্ট স্ক্রিনে নবনির্মিত মন্দিরের মূর্তির ছবি দেখে বিস্মিত বিমলা দেবী। বেণীগঞ্জ তেমাথার কাছে ফুটপাতের উপরে তাঁর ঝুপড়ি। অনেকদিন বাদে সোমবার রোদ ওঠায় শুয়েছিলেন রাস্তার উপরে খাটিয়া পেতে। পাশেই জায়ান্ট স্ক্রিনে প্রাণ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরে উঠে দেখতে এসেছেন। ঘরে টিভি, মোবাইল কিছুই নেই। ভাইরাল হওয়া রামলালা মূর্তির ছবি দেখেননি তিনি। 
ফৈজাবাদের পরে যেখান থেকে অযোধ্যার সীমান্ত সেখানেই রবিবার মধ্য রাত থেকে আটকে দেওয়া হয়েছে রাস্তা। ফলে অযোধ্যায় মন্দিরের আশপাশে ঢুকতে না পেরে রাস্তায় জায়ান্ট স্ক্রিনেই ছিলেন বহু মানুষ। বিশেষত যুবকরা। কাঁধে বিজেপি আর হনুমানের পতাকা নেওয়া দুই যুবকের এক জন বিমলা দেবীকে প্রশ্ন করলেন, তুমি দেখেছো নাকি রামলালাকে? কী করে জানলে কেমন দেখতে? বিমলা দেবী বললেন, ক্যালেন্ডারে তো দেখেছি। এমন কালো নাকি রামলালা! জবাব শুনে থতমত খেয়ে চুপ করে গেল দুই যুবক। বিমলা দেবীর মতোই অযোধ্যার বাসিন্দাদের মূর্তি দেখে মন ভরেনি। রামলালার যেমন ছবি এতকাল দেখে এসেছেন, তার সঙ্গে মিলছে না যে। একজন আবার বলে উঠলেন, এতো পুরো বালাজী। 
দুই বিজেপি কর্মীর একজন চাপা গলায় অন্য জনকে বললেন, ‘‘এটা মোদীজীর মাস্টার স্ট্রোক! দক্ষিণ ভারতে তো পার্টি কিছু করতে পারছে না। রামলালা তো দক্ষিণ ভারতের মতো দেখতে হয়েছে। তাকে এত রামমন্দিরে বসিয়ে দিল। সাউথ ইন্ডিয়ানদের কাছে এটা কত গর্বের! এবার ওখান থেকে কম সে কম একশো সিট আসবে! অন্যজনও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, মোদীজী ১১ দিন ধরে তো বেশিরভাগ সাউথ ইন্ডিয়ার মন্দিরে মন্দিরেই ঘুরলেন।’’ মোদী ভক্তদের একটা সুবিধা আছে, তাঁরা যে কোনও কিছুকেই তাঁর ‘মাস্টার স্ট্রোক’ মনে করে আহ্লাদিত হয়। আবার তাঁর ভণ্ডামি বুঝতে পারলেও তাঁরই সমর্থক থাকে। 
গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার প্রচার করা হয়েছে মোদী রামমন্দির উদ্বোধনের জন্য কী অসীম তপস্যা করছেন। উপবাসে আছেন, ডাবের জল পান করে দিন কাটাচ্ছেন। এদিনও মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ গোবিন্দ গিরি মোদীর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘‘রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে কী কী করতে হবে সেই নিয়মাবলি চেয়েছিলেন মোদী। তিনি বলেছিলেন, তিন দিন উপবাসের কথা। মোদী ১১ দিন উপবাস করেছেন। এই ঠান্ডায় মাটিতে শুয়েছেন।’’ মোদী তখন মাথা নিচু করে বসে আছেন। ক্লাসের ভালো ছাত্রের যখন শিক্ষক প্রশংসা করেন, অনেকটা সেইরকম ভাব মুখেচোখে। মন্দির নির্মাণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা জমা থাকছে গোবিন্দ গিরির তত্ত্বাবধানে। গিরি বলেই চললেন, এমন মহাপুরুষ অতীতে কমই এসেছেন। পুনের আশ্রমের বাসিন্দা গিরি ছত্রপতি শিবাজীর সঙ্গে তুলনা করলেন মোদীর। শিবাজীও সন্ন্যাসী হতে চলে গিয়েছিলেন শিবের আরাধনা করে। তাঁকে মন্ত্রীরা অনুনয়-বিনয় করে ফিরিয়ে আনেন। তারপর এই মোদীজি, যিনি হিমালয় চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে খোদ ভগবতী জগদম্বা তাঁকে ফিরিয়েছেন দেশের কাজ করার জন্য!’’ এরপরে গিরি আসল কথাটা বলেন, ‘‘সব রাজনৈতিক নেতাদেরই মন্দিরে পুজো করতে দেখা যায়, কিন্তু এমন তপস্বী রাষ্ট্রনেতা আর নেই।’’ এটাই আসল কথা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এদিন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেছেন। হিন্দু হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে শুধু মোদীই সাচ্চা। মোদীই তপস্বী। 
হনুমানগড়ির বিজেপি বিরোধী এক মহন্ত বললেন, এতই যখন কৃচ্ছ্রসাধন সরযুতে ডুব দিলেন না কেন? কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের সময়ে তো গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন। চার দিন ধরে যে প্রচার করা হলো সরযুতে স্নান করে মোদী পায়ে হেঁটে মন্দিরে আসবেন, করলেন না কেন? রামেশ্বরমে ডুব দিতে পারেন, সরযুতে যেতে পারেন না? কনকনে ঠান্ডায় সরযুতে ডুব দিয়ে দেখাতেন কত বড় ধর্মাত্মা। তাঁর চেলা সঞ্জয় দাস আবার কবীর আউড়ে বললেন, ‘মন না রাঙায়ে রাঙায়ে যোগী কাপড়া/ আসন মারি মন্দির মে বৈঠে /ব্রহ্ম ছাঁড়ি পুজন লাগি পাথরা।’ যার মোটামুটি অর্থ- মনে ঈশ্বরের প্রতি কোনও প্রেম নেই, শুধু কাপড়টা রাঙিয়ে নিয়েছে সাধুদের মতো। মন্দিরে গিয়ে আসন দখল করে বসে পড়েছে। ব্রহ্মকে ছেড়ে পাথরের পূজা করছে। 
মোদী যদিও নিজের কৃচ্ছ্রসাধনের প্রচারে ক্লান্তিহীন। শুধু গোবিন্দ গিরিকে দিয়ে বলিয়ে হয়নি। নিজের বক্তব্যেও ১১দিনের কথা শুনিয়েছেন। একজন ১১ দিন না খেয়ে কাটানো ব্যক্তির হাত-পা কাঁপবে, গলা শুকিয়ে আসবে, মাথা ঘুরবে এইসবই স্বাভাবিক। কিন্তু মোদীজি মহাপুরুষ, গোবিন্দ গিরি বলেই দিয়েছেন। অতএব তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রাণ দিয়েছেন রামলালাকে। বিশাল মন্দির পরিসরের দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটেছেন। টানা ৩৫ মিনিট গলার স্বর ওঠা-নামা করে ভাষণ দিয়েছেন। তারপরে জটায়ু দেখতে গেছেন। কোনও অসুবিধা হয়নি। 
কিন্তু মোদীর প্রাণ দেওয়া রামলালার থেকে এক বছরের ছোট সুরজের শরীরে ক্লান্তি আছে। লতা মঙ্গেশকর চকে সাধু সন্তদের ভিড়ে পয়সা চেয়ে ফিরছে সে। সঙ্গে আছে বয়সে বড় আর দুই ভাই-বোন। ঠান্ডায় যেন আরও শুকিয়ে গেছে শরীর। ঠিক করে খাওয়া জোটে না। মন্দির দেখার ভিড়ের মধ্যে কিছু পয়সার আশায় ঘুরছে তিন ভাই-বোন। কেউ তপস্বী সাজতে ‘উপবাসে’,  কেউ বাধ্য হয়ে আধপেটা, অনাহারে। 
সুরজ এক বাবাজীর গেরুয়া কাপড় ধরে ডাকতেই রে রে করে উঠলেন, গায়ে হাত দিচ্ছিস কেন? তারপর বোধহয় করুণা হলো। ছুঁড়ে দিলেন দশ টাকার একটা নোট। রাস্তা থেকে নোটটা কুড়িয়ে দিদির হাতে দিল। দিদির হাতেই আছে জমা টাকা। গুনে দেখল সত্তর। হাসি ফুটল পথের রামলালার।  
 

Comments :0

Login to leave a comment