মণিপুরের মহিলাদের বিবস্ত্র করার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা দুনিয়ায় বেআব্রু হয়ে গেছে মোদী সরকারের সময়ে ভারতের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত চেহারা। কিন্তু বুধবার হাজারো আলোর ঝলকানিতে, কুল কুলে ঠান্ডা বিশাল প্রেক্ষাগৃহে ডিজাইনার পোশাকে উজ্জ্বল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন, তাঁর সরকারের কাজে দুনিয়ার সামনে দেশের শোভা বেড়েছে। এদিনের ভাষণে মণিপুরকে ঘিরে দেশের এই ঘোর অন্ধকার সময় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনও কথা না বললেও ছন্দ মিলিয়ে দেশের বর্তমান অবস্থা বোঝাতে যে কবিতা পাঠ করেছেন এদিনের সভায়, তার কয়েকটি লাইন এইরকম- নয়া প্রাতঃ হ্যায়, নয়ি বাত হ্যায়/ নয়ি কিরণ হ্যায়, জ্যোতি নয়ি/ নয়ি উমঙ্গে, নয়ি তরঙ্গে/ নয়ি আশা, শ্বাস নয়ি/... জন জনকে জীবন মে ফিরসে নয়ি স্ফূর্তি, নব প্রাণ...। ঘোর আঁধারে প্রধানমন্ত্রী নতুন ভোর, আলো, প্রাণ, স্ফূর্তি দেখেছেন, দেখিয়েছেন। হল ফেটে পড়েছে অনুগামীদের করতালি, সিটি, স্লোগানে। আত্মমুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী মৃদু মৃদু তৃপ্তির হাসি হেসেছেন।
এদিন নয়াদিল্লির প্রগতি ময়দানে নতুন ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন কাম কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মণ্ডপম’ এর উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ১২৩ একর জমির উপরে ২৭০০ কোটি টাকা খরচ করে এই সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। মূলত জি-২০ বৈঠকের জন্যেই এই সেন্টার তৈরি হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৩ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, বিজেপি’র নেতারা, শিল্প মহল সহ অন্যান্য ক্ষেত্রের আমন্ত্রিতরা। উদ্বোধনের আগে এখানেও প্রধানমন্ত্রী হিন্দু রীতি মেনে পুজো এবং যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। সংসদের নতুন ভবন সহ অন্যান্য যে কোনও সরকারি কাজেও এখন হিন্দু ধর্মাচার প্রকাশ্যেই করছেন প্রধানমন্ত্রী। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের দেশে কিভাবে প্রধানমন্ত্রী এই কাজ করতে পারেন, সেই সব নৈতিকতার প্রশ্ন বহু আগেই জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। এদিন ফের একবার সেই কাজ হয়েছে। এমনকি উদ্বোধনী ভাষণেও ভারত মণ্ডপম নামের সঙ্গেও হিন্দু ধর্মের যোগ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মোদী বলেছেন, ভগবান বাসবেশ্বরের ‘অনুভব মণ্ডপম’র প্রেরণা থেকেই এই মণ্ডপের নাম অনুভব মণ্ডপম করা হয়েছে। মোদী বলেছেন, বাসবেশ্বরের তর্ক-বিতর্ক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, অভিব্যক্তি, অভিমতের যে ধারা, তাকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এখন দুনিয়া এটা স্বীকার করছে ভারত ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’। তামিলনাডু থেকে বৈশালী পর্যন্ত ভারতের ‘ভাইব্র্যান্ট’ গণতন্ত্রের প্রমাণ রয়েছে। তাই ‘ভারত মণ্ডপম’ ভারতের গণতন্ত্রকে দেওয়া উপহার। দ্বাদশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক, ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম বাসবেশ্বর বা বাসবান্না যাকে লিঙ্গায়েতদের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, অনেকদিন ধরেই দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে বিজেপি। যাঁর দর্শন আদতে সম্পূর্ণভাবে আরএসএস-বিজেপি’র বিরোধী। তাঁকেই সামনে এনে এদিন গণতন্ত্রের হয়ে সওয়াল করেছেন মোদী। এমন এক সময়ে মোদী এই সওয়াল করছেন, যখন নিজেই দিনের পর দিন সংসদে যাচ্ছেন না। বাসবান্নার তর্ক-বিতর্ক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, অভিব্যক্তির কথা বলছেন, কিন্তু সংসদে মণিপুর নিয়ে আলোচনা করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানা বিষয়ে ভাষণ দিয়ে চলেছেন, কিন্তু দেশজুড়ে দাবি ওঠার পরেও মণিপুর নিয়ে চুপ করে আছেন। দুনিয়া যখন মণিপুর দেখছে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তাঁর সরকারের সময়ে নাকি ভারতে বৈচিত্রের উদ্যাপন চলছে।
এদিন কারগিল ‘বিজয় দিবস’ এর জন্য নিহত জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানালেও সেই কারগিল যুদ্ধের বীর সেনানির স্ত্রীকে মণিপুরে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে কোনও কথা তিনি বলেননি। এদিন তিনি মূলত নানা পরিকাঠামোগত প্রকল্পের কথা বলে দাবি করেন, গোটা দুনিয়া ভারতকে দেখছে। ভারতে আজ যা হচ্ছে, তা নাকি অকল্পনীয়। কেউ নাকি ভাবতেই পারত না ভারতে এইসব হচ্ছে। তাই এখন থিঙ্ক বিগ, ড্রিম বিগ, অ্যাক্ট বিগ করতে হবে। মোদী বলেন, গত পাঁচ বছরে ১৩ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে গেছে। চূড়ান্ত গরিবী বলে আর কিছু নাকি অবশিষ্টই থাকছে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নাকি এই তথ্য দিয়েছে। যদিও তিনি কারও নাম বলেননি। তাঁর সরকারের সময়ে দেশের কেমন উন্নতি হয়েছে তা বোঝাতে গিয়ে দাবি করেন, দেশের উচ্চতম রেল সেতু, সর্বাধিক উচ্চতায় দীর্ঘতম টানেল, উচ্চতম যানচলাচলযোগ্য সড়কের কথা বলেন। উল্লেখ্য, এই সব প্রকল্পগুলির পরিকল্পনা এবং কাজ শুরু হয়েছিল মনমোহন সিং সরকারের সময়ে। বরং নির্ধারিত সময়ের বহু পরেও তার অনেকগুলির কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি মোদী সরকার। প্রধানমন্ত্রী এদিন দিল্লি এবং আশপাশ অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নের দীর্ঘ ফিরিস্তি দেন। এমন সময়ে প্রধামন্ত্রী এই বিবরণ দিচ্ছেন যখন যমুনার জলে দিনের পর দিন রাজধানীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডুবে রয়েছে।
এদিনের বক্তৃতায় বারেবারেই তিনি স্বভাবসিদ্ধভাবে নিজেকে তুলে ধরেন। মোদী এদিন বলেছেন, তিনি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন বিশ্ব অর্থনীতির নিরিখে ভারত দশম স্থানে ছিল। তাঁর দ্বিতীয় দফায় নাকি ভারত অর্থনীতিতে দুনিয়ার মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। এরপরে নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলেন, ‘আমার তৃতীয় দফায় ভারত দুনিয়ার তৃতীয় অর্থনৈতিক দেশ হয়ে যাবে, এটা মোদীর গ্যারান্টি’।
এমন পরিসংখ্যান অবশ্য মোদী কোথা থেকে পেয়েছেন, সেই তথ্য তিনি দেননি। বারবার তিনি এদিন তৃতীয় দফা সরকারের কথা বলেন। হল জুড়ে মোদী মোদী স্লোগান, সিটির আওয়াজে ভরে ওঠে। বিজেপি’র দলীয় সমাবেশের মতো আবহ তৈরি হয়ে যায়। সরকারি অনুষ্ঠান নাকি নির্বাচনী সমাবেশ, তার কোনও প্রভেদ থাকে না। প্রধানমন্ত্রীকে কেন এদিন বার বার তৃতীয় দফায় সরকারে আসছেন সেই নিয়ে জোর দিতে হলো, তা নিয়ে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বিরোধীদের যৌথ মঞ্চের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধিতার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, শক্তিশালী হচ্ছে, তাতেই প্রধানমন্ত্রীকে বারে বারে এই কথা বলতে হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
Comments :0