শান্তনু চক্রবর্তী
‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘প্রোপাগারে’ থেকে। সাদা বাংলায় যার মানে প্রচার বা আরও আক্ষরিক অর্থে ‘ছড়ানো।’ এমনিতে ঐতিহ্য বা ইতিহাস খুঁজলে ‘প্রোপাগান্ডা’র সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম, যীশুর মহিলা প্রচারেরই যোগ মিলবে। কিন্তু আমাদের এই ২০১৪ উত্তর ভারতবর্ষীয় অভিজ্ঞতায়, ‘ছড়ানো’ বললেই কেন যেন গুজব, মিথ্যে বা ভুয়ো খবরের কথাই মনে আসে। ঘর পোড়া গোরু থুড়ি নাগরিকদের যা হয় আর কী! এই ক’বছরে ঘর তো কিছু কম পুড়ল না! বানানো, সাজানো, জাল খবর আর গুজবের বানের জলে মানুষও কিছু কম ভেসে গেল না! হিন্দুত্ব-ব্রিগেড, সঙ্ঘ পরিবার আর তাদের সংগঠিত করিৎকর্মা আইটি সেল, এই মিথ্যের বেসাতিটাকে গত কিছু বছরে একেবারে কুশলী শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মাস-মাইনের দক্ষ নিপুণ সামাজিক-মাধ্যম বিশেষজ্ঞ বাহিনী, এইসব তথ্য খবর গুজব নির্মাণ ও বিপণন করে থাকে। বিকৃত, নির্মিত মিথ্যা আর মিথ্যার চেয়েও বিপজ্জনক অর্ধসত্য ফেসবুকে, হোয়াটঅ্যাপে সাধারণ মানুষের হাত-ব্যাগে-পকেটে এমন কি কোমরের গেঁজেয় জড়ানো মোবাইল ফোনে, আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সত্যাসত্য যাচাই না করেই মানুষ সেটা বিশ্বাস করে। প্রভাবিত, প্ররোচিত, উত্তেজিত হয়। প্ররোচনা, উত্তেজনা ছড়ায়। সেইসব প্ররোচনা, উত্তেজনায় মানুষ ধৈর্য, যুক্তি কাণ্ডজ্ঞান সব হারায়। তার ন্যায় নীতি বিবেক এমন কি মনুষ্যত্বও লোপ পায়। সে তখন এক অন্ধ বধির হিংসা যন্ত্র। তখন বিদ্বেষই তার একমাত্র বিশ্বাস। ঘৃণাই তার একমাত্র ধর্ম। তার মতোই বিদ্বেষী, বিশ্বাসী, উন্মত্ত জনতা পিন্ডের অংশ হিসেবে সে তখন যে কোনও কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
গুজব-প্ররোচিত এমন একটা জনতা-পিন্ডই আখলাককে দলে থেঁতলে পিষে মেরেছিল। কারণ তাঁর বাড়ির ফ্রিজে যে মাংসটা ছিল, সেটার চেহারা চরিত্র নিয়ে সন্দেহ ছিল। উড়ো বা ভুয়ো খবর ছড়িয়ে, সংগঠিত সাম্প্রদায়িক গণপিটুনি বা ‘মব লিঞ্চিং’ এভাবেই এনডিএ শাসনাধীন, ‘গণতান্ত্রিক হিন্দু ভারতের’ নতুন ন্যারেটিভ হয়ে ওঠে। গুজব বা জাল খবরের পরাক্রম আর গোরু ও সনাতন নারীর ‘সম্ভ্রম’ সুদ্ধ হিন্দুত্বের স্বঘোষিত রক্ষকদের ধৃষ্টতা প্রতিদিন বাড়তে থাকে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, সন্ত্রাস, হত্যালীলা চালানোর অজুহাত হিসেবে মিথ্যে বা আধা সত্য খবরের পাশাপাশি নকল ছবি বানানো ভিডিও ব্যবহার করা হয়। বিদ্বেষ ছড়াতে, অন্য কোনো রাজ্যে, অন্য কোনো ঘটনার ছবি, ভিস্যুয়াল এমন কি সিনেমার দৃশ্যও তুরুপের তাস হয়ে যায়। মণিপুরে দুই কুকি মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানোর যে ভিডিও গোটা পৃথিবীতে ভারতের মাথা নিচু করে দিয়েছে, সেই ঘটনার ইন্ধনও যুগিয়েছিল কিন্তু একটি ‘মিথ্যে’ ছবি। যেখানে দিল্লির ‘অনার কিলিং’ বা পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য বলে দেওয়া একটি মেয়ের মৃতদেহের ছবিকে মণিপুরের জাতিদাঙ্গায় নিহত ঙেইতেই কন্যা বলে চালানো হয়। এভাবেই গুজবের ভেলায় ভেসে দেশের এক প্রান্তের হিংসার ছবি, দেড় দু-হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে, অন্য প্রান্তে অন্য প্রেক্ষিতে একইরকম গণ-হিংসার অনুঘটকের কাজ করে। আর সরকারের পোষা কেনা, অনুগৃহীত ও অনুগত সংবাদ মাধ্যম বা তথাকথিত গদি মিডিয়া সরাসরি ‘ফেক নিউজ’ হয়তো তৈরি করে না। কিন্তু পরোক্ষভাবে সেই জালি সাংবাদিকতারই পৃষ্ঠপোষকতা বা দালালি করে। প্রধানমন্ত্রী মোদী বা বিজেপি’র সমস্যা হতে পারে, এমন যাবতীয় খবর চেপে বা ছেঁটেকেটে বা সেন্সর করে আসা খবরের অভিমুখ পালটে, গুরুত্ব কমিয়ে পরিবেশন করা হয়। কিংবা হোয়াটঅ্যাবাউটদিস’ -এর চাষ করা হয়! মোদীর আমলে এই হয়েছে বলছ— এই তো কংগ্রেস শাসনেও এই এই হয়েছে! ডাবল ইঞ্জিন সরকার শাসিত রাজ্যে ধর্ষণ বেড়েছে বলছ? ওই তো তোমাদের রাজস্থান-ছত্রিশগড়েও নারী নির্যাতনের কমতি কি বাপু? তার বেলা? তার বেলা?
এভাবেই সঙ্ঘ পরিবারের আইটি সেল আর রাজনৈতিক ক্ষমতার কোলে দোল খাওয়া, আদরে আদরে ‘বাঁদর’ হওয়া (অবশ্যই হনুমানের মত ভক্তি প্রাণ!) মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, হাতে হাত মিলিয়ে গত ৯ বছরে এদেশে ‘রাষ্ট্রবাদী’ সাংবাদিকতার এক নয়া যুগ এনে ফেলেছে। দু তরফের যৌথ উদ্যোগে, কখনও কখনও পিপিপি মডেলেও সামাজিক মাধ্যমের অতল অফুরান তথ্য বা কনটেন্ট সাগরে, ২৪x৭ অবিরাম অনর্গল ভাসিয়ে দেওয়া হয় চাপা খবর, পয়সা দিয়ে ছাপা খবর, উড়ো খবর, ঝুরো খবর — এমন কি চুরমুর-এর মতো চটপটি গুঁড়ো খবর বা খবর চূর্ণও — সংবাদ চ্যানেলের ২ মিনিটে ২টো খবর বা ১০ মিনিটে ৬০টা খবরের স্লটে অথবা আপনার টিভির পর্দার নিচের দিকের স্ক্রিনে এইসব খবরের গুঁড়ো ছড়ানো থাকে। এর মধ্যে কিছু ‘গুঁড়ো’ অসমর্থিত সূত্রে’ পাওয়া। আরও কিছু কিছু থাকে, সেসবও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এইসব ভেসে আসা, উড়ে পড়া খবরের গুঁড়ো থেকে যদি কিছু ঘটেও যায়, তার দায় কর্তৃপক্ষের নহে! সত্যি বলতে কি, ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা বাহুবলী, বীরবিক্রম প্রধানমন্ত্রীজীকে নৈতিক সুরক্ষা দেওয়া ছাড়া গদি মিডিয়ার আর কোনো ব্যাপারেই কোনো দায় নেই। তারপরেও একটা ব্যাপারে খটকা কিছুতেই যায় না। এইসব আশ্রিত শরণাগত ভক্ত মিডিয়া তো দিনরাত্তির এতো সাধন ভজন করে এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, ২০১৪’র পর থেকে এই ভারতের মহামানবের যা ‘উন্নয়ন’ হয়েছে, আগের ৬৭ বছরে তার সিকিও হয়নি। ‘রাষ্ট্রবাদী’ চ্যানেলের সঞ্চালক মাস্টারমশাইরা রীতিমত ‘পাঠশালা’ খুলে কালো বোর্ডের ওপর সাদা চক খড়ি দিয়ে, অলৌকিক সব অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিচ্ছেন, এই ৯ বছরে দেশ এমন গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলেছে, তার পাশে চীন, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া সব ফেল মেরে যাচ্ছে! ভারত তথা মোদীহীন ‘বিশ্বগুরু’ হওয়া ঠেকাবে সাধ্য কার! এখন এইসব আঁকড়ি বুকড়ি সেসব তর্কেও আমরা ঢুকছি না! আমাদের অবোধ মনের একটাই সরল জিজ্ঞাসা — উন্নয়নের এমন দেশছোড়া ‘উৎসবের’ পরেও যে কোনো নির্বাচন এলেই বিজেপি কেন সেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মোডএই ফিরে যায়? তাদের অমন যে জবরদস্ত, ‘বিকাশপুরুষ’ যিনি ভারতকে ‘স্বচ্ছ’, ‘ডিজিট্যাল’, ‘আত্মনির্ভর’ আরও কত কী করেছেন — ভোট এলে তাঁরও সেই বিখাশের লিস্টি কিংবা খাতাটা কোথায় যে হারিয়ে যায়! আর তিনি নরেন্দ্র দামোদর মোদী, নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে যাঁর হাসিমুখের ছবি দেখা যায়— ভোটের প্রচারের সময় তাঁর অন্দরের আদি অকৃত্রিম আরএসএস প্রচারক জেগে ওঠে! অ্যান্টি ন্যাশনালদের তালিকায় বাম, কংগ্রেসের পাশাপাশি গজনীর মামুদ, মহম্মদ ঘোরী, বাবর, আকবর, আওরঙ্গজেব এমনকি টিপু সুলতানরাও চলে আসেন। তাঁর সরকারের আমলে ভারতের কৃষক-শ্রমিক-দলিত আদিবাসী- প্রান্তিক মানুষের এত ‘সুখ-সমৃদ্ধি’ হওয়ার পরেও ভোটের বাজাবে বিজেপি, বিরোধীদের সেই মুসলিম তোষণ, সন্ত্রাসবাদী পোষণ, হিংসা, লাভ-জিহাদ মন্দির মসজিদ গোরক্ষার বাইরে ইস্যু খুঁজে পায় না। আইটি সেল, হোয়াটস-অ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ভক্ত মিডিয়াদেরও তাই বিষাক্ত বিভাজন আর কুশলী হোয়াটসঅ্যাবাউটদিস প্রচারটা চালিয়ে যেতেই হয়। আর এই জায়গায় দাঁড়িয়েই সঙ্ঘ পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ একটা ধারাবাহিক ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলে চলে। এমনই একটা ন্যারেটিভ বা রাষ্ট্রীয় বয়ান তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। যেটা ভারতবর্ষকে আন্তর্জাতিক জেহাদি মুসলিম সন্ত্রাসবাদের নরম ‘টার্গেট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। হিন্দুত্বের সেই প্রচার কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা অবধি ইসলামের ‘শয়তানি’ চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে আছে।
সেই গভীর ষড়যন্ত্রে শান্তির পীঠস্থান ভারতবর্ষ, সেই শান্তির আধার ভারতের সনাতন ধর্ম, সেই ধর্মের প্রতীক মন্দির, গোমাতা সনাতন নারীর আব্রু সম্ভ্রম পবিত্রতা সবটাই ‘বিপন্ন’। ভারতের শান্তি-সুস্থিতিকে ধ্বংস করার এই প্যান ইসলামিক বৃহত্তর চক্রান্তের সহযোগী বা এজেন্ট হিসেবে ভারতীয় মুসলিমদের ভূমিকাও অবশ্যই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারে সেই ন্যারেটিভটাই প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চলে। সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে কোনও বিজন মরুভূমিতে, আইসিসি কিংবা আল কায়েদা ভারতের বুকে ইসলামি তাণ্ডব ঘটাতে চায়। এদেশের মুসলিমরা তাদের ‘স্লিপার সেল’। নীরবে গোপনে তারা সন্ত্রাসের সংগঠন গড়ে তোলে। তাই প্রত্যেকটা মসজিদ, প্রত্যেকটা মাদ্রাসা, প্রত্যেকটা মুসলিম মহল্লাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। মুসলিম যুবক, কোনো হিন্দু তরুণীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে, এমনকি স্রেফ বন্ধুত্ব করতে এলেও ধরে নিতে হবে, তার পেছনে কোনো ভয়ঙ্কর জেহাদি পরিকল্পনা আছে। প্রত্যেক দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী হিন্দুর তাই আশু, আবশ্যিক রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হল, প্রত্যেক প্রতিবেশী মুসলিমকে সন্দেহ করা— তাঁদের সম্পর্কে সজাগ এবং সতর্ক থাকা। তাহলেই ভারতবর্ষ সুরক্ষিত থাকবে। মনে রাখতে হবে, শুধু সীমান্তে সেনাবাহিনী নয়— দেশের অন্দরেও প্রত্যেক হিন্দু ভারতবাসী ভারতমাতার বীর সিপাহী। শত্রু নিধনে যেন তাদের হাত না কাঁপে।
এই জঙ্গি হিন্দুত্বের রেটোরিক-ই তিন দশক আগে বাবরি মসজিদের শেষ ইটটাও অযোধ্যার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। সঙ্ঘ পরিবার সেই অবিশ্বাস-বিদ্বেষ-ঘৃণার আবহকে কখনই থিতিয়ে যেতে দেয়নি। তবে ২০১৪’র পর থেকে হিন্দুত্বের সেই প্রকল্প আরও অনেক বেশি প্রগলভ, নির্লজ্জ, হিংস্র হয়েছে ভারতীয় মুসলিমদের দেশপ্রেম নিয়ে।
একটা সংশয় আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে স্বাধীন ভারতের শুরু থেকেই জিইয়ে রাখা আছে। এই সংশয়ই ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময়, সৈয়দ মুজতবা আলির মতো একজন আনখশির অসাম্প্রদায়িক মুক্ত চেতনার মানুষকেও স্রেফ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ‘পাকিস্তানী গুপ্তচর’ ভেবে নিতে লজ্জিত হয়নি! সুতরাং স্বাধীনতার এই অমৃতকালে; হিন্দু-স্বাভিমানের গর্বিত দাপাদাপির সময়ে যে কোনো মুসলিম ভারতীয়কে ‘বাবর কা আওলাদ’ বা ‘গো টু পাকিস্তান’ বলতে রাজনৈতিক রুচিতে একটুও যে বাধবে না সেটা বলাই বাহুল্য। বরং মোদী জমানায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এই যে তার সবটুকু আক্রোশ নির্দ্বিধায় কোনো রাখঢাক না করেই উগরে দিতে পারছে ‘গদ্দার’, ‘মীরজাফর’দের খুল্লমখুল্লা গুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা যাচ্ছে, সরকার-পুলিশ কেউ কিছু বলছে না— এটাকেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা উৎসব বলে উদযাপন করা হচ্ছে! গদি-মিডিয়ারও তাতে পুরোদস্তুর সায় আছে। ‘গরব সে বোলো হাম হিন্দু হ্যায়’— গোছের স্লোগান না দিলেও নিজের দেশে হিন্দু কেন তার গৌরব আর অধিকারের কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারবে না, তাই নিয়ে জাতীয় চ্যানেলগুলো অক্লান্ত বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারে। এমন কি সামাজিক মাধ্যমে নিত্যদিন উগ্র আগ্রাসী হিংসাত্মক হিন্দুত্বের স্রোত যুক্তি-বিবেচনার দু-কূল ভাসিয়ে বয়ে চলে, গদি মিডিয়া সেটাকেও প্রায় বৈধতা দিয়ে ফেলে।
সামাজিক মাধ্যম বোঝাই করে এই যে তথাকথিত ‘ফেক নিউজ’ পোস্ট ট্রুথ-এর সুপরিকল্পিত ওড়াউড়ি, ঘোরাঘুরি —সেটা ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে অপদস্ত বা আদারনেম-কে ‘ন্যায্য’ ও প্রামাণ্য করে তোলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার চৈতন্যে তাদের ভারতীয়ত্বকে রোজ কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। নিজেদের মতলব হাসিল করার জন্য ‘তথ্য’ বা ‘সত্য’ নির্মাণের এই যে ‘মেকানিজম’ সাম্প্রতিক ‘আফওয়া’ ছবিটা তার ভাঁড়ার ঘর, হেঁসেল অবধি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এই ছবিটা যখন কিছুদিন আগে সিনেমা ঘরে মুক্তি পেয়েছিল, তখন ছবি প্রদর্শনের নানা বাণিজ্যিক প্যাঁচ পয়জার আফওয়াকে ৭ দিনও চলতে দেয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে মণিপুর যখন গুজবের আগুনে প্রতিদিন ঝলসে যাচ্ছে — রক্তের ছিটে আর লাশ গুনতে গুনতে সেখানকার ভূমিপুত্র-কন্যারা আর্তনাদ করছেন— এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়— তখন ওটিট প্ল্যাটফর্মে এই ছবিটা দেখে মানুষ নতুন করে চমকে উঠছেন! সুধীর মিশ্রের ছবিটির পটভূমি অবশ্যই মণিপুর নয়, রাজস্থান। ছবির প্রি-টাইটেল সিকোয়েন্স এই আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজ্যের শাসক রাষ্টীয় বিকাশ দলের তরুণ তুর্কী যুবনেতা বিক্রম সিং, সাওয়ালপুর শহরের মুসলিম মহল্লা তথা কানাইপল্লির ভেতর দিয়ে ‘র্যা লি’ বা রোড শো করছেন। খোলা জিপে দাঁড়িয়ে কর্ডলেস মাইক হাতে অঞ্চলের ভূতপূর্ব সামন্তপ্রভু বিক্রম ওরফে ভিকি বানার মুখে সুস্পষ্টতই উসকানিমূলক ভাষণ সহিষ্ণুতার দিন শেষ, এবার অ্যাকশনের পালা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরের ঘটনাক্রম যেমন হওয়ার তেমনই। ভিড়ের ভেতর থেকে ছোঁড়া ইটের টুকরো ভিকির কপালে এসে লাগে। তারপরেই পার্টির ভৈরব বাহিনী আশেপাশের সংখ্যালঘু জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভিকির ডান হাত চন্দন মাংসের দোকানের শাটার নামিয়ে এক কসাইকে খুন করে।
তবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, সংখ্যালঘু এলাকায় কিভাবে দাঙ্গা বাধায়, সেটা এ ছবির বিষয় নয়। ভিকির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিকাশ দলের রাজ্য সু্প্রিমো জ্ঞান সিংহের মেয়ে নটীর বিয়ের কথা পাকা। কিন্তু শিক্ষিতা আধুনিকা নটী বাড়ি থেকে পালায়। ভিকির দলবল যখন তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, তখনই ঘটনাস্থলে এসে পড়েন সদ্য আমেরিকা ফেরত বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রাহাব আহমেদ। তিনি যাচ্ছেন নাহারগড়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে। সেখানে তাঁর লেখিকা স্ত্রীর নতুন বই প্রকাশ অনুষ্ঠান। কিন্তু রাস্তায় কিছু গুন্ডা একটি যুবতী মেয়েকে ধরে টানাটানি করছে অথচ পথচলতি লোকজন উদাসীন। এড়িয়ে যাচ্ছে দেখেই। তিনি স্বাভাবিক মানবিকতাবোধে এগিয়ে যান এবং নটীকে উদ্ধার করেন। ঘটনাটা এইটুকুই। কিন্তু নটীর সঙ্গে ভিকি বাহিনীর ধস্তাধস্তি, সেই ফ্রেম-এ রাহাবের প্রবেশ এবং শেষ অবধি নটীকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়া্ — এই পুরো ভিস্যুয়ালিটার যে ভিডিওটা সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয় বা রাষ্ট্রীয় বিকাশ দলের তরফে ভাইরাল করা হয়, সেখানে শুধু একটা হ্যাসট্যাগ ‘লাভ জিহাদ’ জুড়ে দিয়েই গোটা বিষয়টার প্রেক্ষিত আর অভিমুখটাই বদলে দেওয়া হয়। এই যে নতুন ন্যারেটিভটা তৈরি হয়, সেখানে একটু আগের উদার, এলিট মুসলিম রাহাব রাতারাতি পাক্কা লাভ জেহাদী।, সন্ত্রাসবাদী শয়তান! গোটা রাজস্থান তাঁর রক্তদর্শন করতে চায়। বিদ্রোহিনী নটী নেহাতই অসহায়। হিন্দু-বালিকা —বিধর্মীর লোভী মতলবি নোংরা হাত তার ইজ্জত মর্যাদা ছুঁয়েছে। আর যুবনেতা ভিকি এক ট্র্যাজিক হিরো নিজের ‘প্রাণ বিপন্ন’ করেও যে হিন্দু নারীর সম্ভ্রম বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল! এই যে সামাজিক মাধ্যম স্ট্র্যাটেজিস্ট-এর দৌলতে ভিকির কলঙ্কিত, ভাঙা ইমেজ জোড়া লাগে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে স্লোগান তোলাই যায়— দেশ কা নেতা ক্যায়সা হো, ভিকি বানা য্যায়সা হো!
‘আফওয়া’ ছবির সব চরিত্রই কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তবেও সঙ্ঘের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি তো এভাবেই, নির্মম পেশাদারি দক্ষতায়, আফওয়া গুজবকেই ‘সত্যি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়— ‘নয়’-কে ‘হয়’ করে তোলে। সেই প্রচারের জগঝম্বে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ বা ‘কেরালা স্টোরি’ও ঐতিহাসিক দলিল ওয়ে ওঠে। অনেকে তার অজান্তেয় চটপট বিশ্বাসও করে ফেলেন। এটাই সঙ্ঘ পরিবারের ‘মোডাস অপারেন্ডি।’ সুধীর ‘আফওয়া’ ছবির ক্লাইম্যাক্স-এ তবু একটা ‘পোয়েট্রিক জাস্টিস’ দেখিয়েছেন। সেখানে ভাইরাল গুজবের পাতা ফাঁদে খোদ শিকারীই ‘শিকার’ হয়ে যায়। তবে সঙ্ঘ পরিবারের হিংসার আপন ভুবনে ফাঁদপাতা ওভাবে লক্ষ্য ফসকায় না। নিছক রটনা থেকে ‘তৈরি করা’ ঘটনার প্রবাহে সেখানে কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, এমন কি একটা গোটা জনগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও অনায়াসে ‘দুর্বৃত্ত’ বা দেশের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই ছকে ভারতবর্ষে যেমন সমস্ত মুসলিমই সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী, এই মুহূর্তে মণিপুরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই কুকি জনগোষ্ঠীকেও সামগ্রিকভাবে বহিরাগত, অপরাধপ্রবণ, মাদক পাচারকারী হিসেবে দেগে দিতে চাইছে। বলা যায় না, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের গেমপ্ল্যান হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই, এইসব ‘সত্য’ ‘প্রমাণে’র ভিত্তিতে ‘মণিপুর ফাইলস’-এর মতো আস্ত সিনেমাও বানিয়ে ফেলতে পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
Post Editorial on propaganda
গুজবের রাজনীতি, রাজনৈতিক গুজব!
×
Comments :0