ইস্তফা গ্রহণ করা হলো না, বদলি করা হলো ধিক্কৃত সন্দীপ ঘোষকে। তার বদলে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে এলেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুহৃতা পালকে। আর জি কর হাসপাতালকে কেন্দ্র করে মমতা ব্যানার্জির সরকার আরও একবার প্রমাণ করল— অপরাধ, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশাসন সব মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া যায়!
সোমবার সকালে সন্দীপ ঘোষ সাংবাদিকদের জানান, ‘‘আমি পদত্যাগ করছি অধ্যক্ষ পদ থেকে।’’ পরে তিনি জানান, চাকরিই ছেড়ে দিচ্ছেন। এমনও দাবি করেন, তিনি স্পষ্ট বক্তা বলেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে। আবার এও দাবি করেন যে, তরুণী চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন এমন কথাও তিনি বলেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সন্দীপ ঘোষেরই পাশে দাঁড়িয়েছেন। সোমবার তিনি বলেন, ‘‘আমি তাঁকে বুঝিয়েছি, আপনাকে ওখানে কাজ করতে হবে না। আমরা ওনাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’’এদিন বিকালে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে নির্দেশিকা দিয়ে জানানো হয়, সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে বদলি করা হয়েছে। অবশ্য সেখানকার ছাত্ররা সেই নির্দেশের কথা শুনে অধ্যক্ষর ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। পড়ুয়ারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, সন্দীপ ঘোষকে তাঁরা অধ্যক্ষ মানবেন না। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, সকালে পদত্যাগের ঘোষণা করে সন্দীপ আসলে ‘ব্ল্যাকমেল’ করেছে সরকারকে। তিনি সরকারের, তৃণমূলের অনেক কেচ্ছা জানেন। তাই মুখ্যমন্ত্রীকে মুখ খুলতে হয়েছে তাঁর পক্ষে। তাঁর বদলে আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ করা হচ্ছে ডাঃ সুহৃতা পালকে।
কে এই সুহৃতা পাল? তিনি আগে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তাঁকে কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপালের নির্দেশে উপাচার্যের পদ ছাড়তে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছে হাইকোর্টে। এরই মধ্যে এমন ব্যক্তিকে এক সংবেদনশীল পরিবেশে আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ পদে নিয়ে এলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল’র যুগ্ম আহ্বায়ক ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডাঃ হীরালাল কোনার।
বোঝা যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জি নিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কাউকে ছাড়া আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ করতে চাইছেন না। আবার আর জি কর হাসপাতালে নানা দুর্নীতি, দুষ্কর্ম যাঁর আমলে হয়েছে, সেই সন্দীপ ঘোষের পক্ষেও তিনি আছেন। এর আগেও একাধিকবার বদলির নির্দেশ বদলে গিয়েছে সন্দীপ ঘোষের।
এদিনই নিহত তরুণী চিকিৎসকের দেহরসের নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য হায়দরাবাদের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এই রিপোর্টে বোঝা যেতে পারে অপরাধীরা সংখ্যায় কত জন ছিল।
আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার রাতে কলকাতায় এলেন জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। তাঁরা লালবাজারে পদস্থ পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে সোমবার আর জি কর হাসপাতাল থেকে চার জনকে লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছে। রীতিমতো নোটিস পাঠিয়ে ডাকা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিন জন চিকিৎসক। মঙ্গলবার কলকাতা পুলিশের তরফে হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, চেস্ট বিভাগের প্রধানকে লালবাজারে তলব করা হয়েছে। আর জি করের এই অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারই ওই তরুণী চিকিৎসকের বাড়িতে ফোন করে প্রথম খবর দিয়েছিলেন।
একাধিক অভিযুক্ত জড়িত থাকার তত্ত্ব যে পুলিশ একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না, এদিন তাও কার্যত বুঝিয়ে দেন পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, ‘‘যদি আরও কেউ জড়িত থাকেন, আমি নিশ্চিত আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। তার পরও যদি পরিবার সন্তুষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা-ই হবে।’’ পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, ‘‘আমরা একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছি। যদি কারও উপর সন্দেহ থাকে, তা আমাদের জানান। নাম গোপন রেখেও জানাতে পারেন। সশরীরে এসেও জানাতে পারেন।’’ এদিকে জেলায় জেলায় সরকারি হাসপাতালগুলিতে কর্মবিরতি করছেন চিকিৎসকরা। সোমবার থেকে চিকিৎসকদের জাতীয় স্তরের সংগঠনও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে। যার ফলে হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সোমবার দুপুরে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা এক সাংবাদিক বৈঠক জানান, তাঁদের ৬ দফা দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন বন্ধ হবে না। এই ঘটনায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে হবে। বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। একইসঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ এবং ময়নাতদন্তের তথ্য তাঁদের জানাতে হবে। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার, চেস্ট বিভাগের প্রধান এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের আউটপোস্টের সহকারী পুলিশ সুপারকে পদত্যাগ করতে হবে। তাঁদের লিখিতভাবে ক্ষমাও চাইতে হবে। ভবিষ্যতে আর কখনও যাতে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পদে তাঁদের দায়িত্ব না দেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি নজরদারি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ পিকেটিং এবং পর্যাপ্ত পুলিশি টহলদারির ব্যবস্থা করতে হবে। এই ঘটনায় কলকাতা পুলিশকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সে সঙ্গে নির্যাতিতার পরিবারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা।
RG Kar
সন্দীপের বদলি ন্যাশনালে, দু্র্নীতিতে অভিযুক্ত এলেন আর জি করে
×
Comments :0