‘‘দাদা আমি বড় হয়ে আইনজীবী হতে চাই।’’ বললেন রূপসা মণ্ডল।
কেন আইনজীবী কেন?
কোনও মানুষ যাতে বিনা অপরাধে শাস্তি না পায়, তাদের অধিকার যাতে রক্ষা পায় তাই।
রূপসা, কলকাতার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরি কলেজের বি কমের ছাত্রী। আর জি করকাণ্ডের প্রতিবাদ নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করায় গত ১১ সেপ্টেম্বর বাড়ির দরজা ভেঙে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। তারপর পাঁচদিন জেলে থাকতে হয়েছে তাকে। ১১ তারিখ ঠিক কি হয়েছে তা জানতে চাওয়া হলে বছর ২০’র রূপসা বলেন, ‘‘আমি কোনোদিন এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। খুব ভয় লাগছিল।’’
তারপর এক নাগাড়ে সে বলতে থাকে সেদিনের কথা। রূপসা বলেন, ‘‘আমি আমার ঘরে দরজা দিয়ে কাজ করছিলাম। সেই সময় হঠাৎ করে কয়েকজন এসে আমার বাবাকে ডাকেন। তারপর বাবা এসে বলে পুলিশ ডাকছে। দরজা বন্ধ অবস্থায় আমি বলি যে কেন ডাকছেন আমায়। ওপার থেকে উত্তর আসে তোমায় আমাদের সাথে যেতে হবে। আমি দরজা খুলিনি। তারপর চোখের সামনে দেখলাম বাইরে থেকে ধাক্কা মেরে মেরে ঘরের দরজাটা ভাঙা হলো।’’
তারপর?
দু’জন মহিলা আধিকারিক ঘরে আসেন আমায় আসামির মতো দু’জন দু’দিক দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। খবর পেয়ে ততক্ষণে বাড়ির সামনে আমার এক দিদি চলে এসেছে। ও আমাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে পুলিশ ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।
রূপসার বাড়ি গড়ফা থানার এলাকায় হলেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় যাদবপুর থানায়। বাড়ির লোককে না জানিয়েই তাকে যাদবপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানায় রূপসা। তারপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজার।
রূপসা জানান, লালবাজারে তাকে একজন মহিলা আধিকারিক মারধরও করেন। তবে সেখানে থাকা অন্য কয়েকজন আধিকারিক তার প্রতিবাদও করেন।
পাঁচ দিন জেলে থাকার সময় কি বাড়ি লোকের সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে পেরেছিলে?
- না। একদিনও না। মাঝে শুধু প্রথম দিন যখন আদালতে পেশ করা হয় সেই সময় বাড়ির লোককে দেখেছিলাম গাড়ি থেকে।
কি বলেছিল তারা?
- ভয় পাস না।
আলিপুর আদালতে রূপসার হয়ে প্রায় ৩০ জন আইনজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। এত জন আইনজীবী যে তার হয়ে লড়াই করবে তার ভাবতে পারেনি পূর্বাচল এমজি রোডের বাসিন্দা মেয়েটি। এই কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার গলা কেঁপে আসছিল রূপসার।
আর জি করের ঘটনা তাকে নাড়া দিয়েছে। তাই সে নিজেকে কোনোভাবে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। রাত জাগা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে সে। যাদবপুরের আদর্শ বালিকা শিক্ষায়তনের প্রাক্তন এই পড়ুয়া বলেন, ‘‘একটি মেয়ের সঙ্গে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল কি করে চুপ করে থাকতে পারি বলুন, আমিও তো একজন মেয়ে।’’
রূপসার বাবা দিবাকর মণ্ডল দোকানে দোকানে প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি করেন। ওটাই একমাত্র রুটি রুজি। ২০১৬ সালে মাকে হারিয়ে বড় হয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানো এবং পরিবারের হাল ধরার একটা জেদ তার মধ্যে কাজ করছে।
রূপসা বলেন, ‘‘২০১৬ সালে মা মারা গিয়েছেন। বাবা, ঠাকুমা এবং আমি এই তিনজন আমরা থাকি।’’ গোটা পরিবারটা রূপসার বাবা চালান।
রবিবার রূপসা মণ্ডল জামিন পাওয়ার পর তার বাসস্থান হালতুতে একটি নাগরিক মিছিল হয়। সেখানে তার থাকার কথা থাকলেও থাকতে পারেননি। কিছুটা আক্ষেপের সুরেই সে বলে, ‘‘আমার তো মাটিতে শোয়ার অভ্যাস নেই। ওখানে টানা মাটিতে শুতে হয়েছে ঠান্ডা লেগে শরীর খারাপ করেছিল তাই যেতে পারিনি।’’
তবে শ্যামবাজারের ধরনা মঞ্চে এবং স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়ার ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে রূপসা গিয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা সেখানে তুলে ধরেছেন। বিচার না পাওয়া সেও যে এই আন্দোলনের অংশ হয়ে থাকবে সেকথাও জানিয়েছে।
তবে রূপসা না থাকলেও মিছিলে সেদিন সামনে জাতীয় পতাকা হাতে উপস্থিত ছিলেন দিবাকর মণ্ডল। সেদিন মিছিলের শেষে তিনি বলেন, ‘‘সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের পাশে থাকার জন্য।’’ অভিষিক্তা মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আড়ষ্টতা নিয়ে দিবাকর মণ্ডল যখন এই কথা বলছেন তখন বহু মানুষ যারা কোনোদিন রূপসা মণ্ডলকে চিনতেন না তারা বলেছেন পাশ থেকে, ‘কোনও চিন্তা করবেন না আমরা সবাই আছি।’
রূপসা নিজেও এই সবে কিছুটা অবাক এনজি রোডের মেয়ে থেকে রূপসা আজ হয়ে উঠেছে একটা মুখ। আন্দোলনের একটা মুখ।
রূপসা বলেন, ‘‘আমি সত্যি ভাবতে পারিনি এতো মানুষ আমার পাশে থাকবেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’’
Comments :0