সেদিন ময়নাতদন্তের রিপোর্টও বদলানোর জন্য চাপ দিয়েছিল ধৃত সন্দীপ
আর জি করের ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকের ভূমিকা সিবিআই-র নজরে
পরিকল্পিতভাবে নমুনা পরীক্ষার জন্য দেরিতে পাঠানো হয়েছিল তাঁরই নির্দেশে
নমুনার যাতে সংমিশ্রণ ঘটে যায় তাই এমন কৌশল
------------------------------------------------
নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ১৬ সেপ্টেম্বর- তখনও ময়নাতদন্ত শেষ হয়নি। অপেক্ষায় খোদ আর জি করের তৎকালীন প্রাক্তন অধ্যক্ষ ধৃত সন্দীপ ঘোষ ও আর জি করের ফরেন্সিক বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর দেবাশিস সোম। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পরেই তিন সদস্যদের চিকিৎসকে দলকে খোদ সন্দীপ ঘোষ চাপ দিয়েছিলেন যাতে ‘ফোর্সিবলি পেনিট্রেশন’ শব্দবন্ধ না থাকে। যদিও বিবেকেরা তাড়নাতেই সেই দাবি মানতে অস্বীকার করেন ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা।
৯ আগস্ট তখনও হাসপাতালে রয়েছে ঐ চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহ। সবেমাত্র ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। বাবা-মাও হাসপাতালে। পুলিশ তখন চাপ দিচ্ছে দ্রুত দেহ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা। মানছেনা পুলিশ, নেতৃত্বে টালা থানার ওসি। সেই সময়তেই আর জি করে ঐ ধিক্কৃত প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘরে চলে রুদ্ধদার বৈঠক। সেখানেই ঠিক হয় পরবর্তী পরিকল্পনা। সেখানেই ঠিক নয় নমুনা যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা সেদিনই পাঠানো হবেনা। শনি-রবিবার পেরিয়ে সোমবার পাঠানো হবে। এই পরিকল্পিত বিলম্ব আসলে তথ্য প্রমাণ লোপাটের গোটা ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশ বলে দাবি সিবিআই-র।
আর সেই সূত্রেই সামনে আসছে আর জি করের ফরেন্সিক বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর দেবাশিস সোমের প্রসঙ্গ। ইতিমধ্যে সন্দীপ ঘোষকে জেরা করে মেলা তথ্যের পাশাপাশি একাধিক তথ্য প্রমাণও হাতে এসেছে সিবিআই-র। ৯ তারিখ প্রথম থেকেই আর জি করে এবং ঘটনাস্থলেও দেখা গিয়েছিল দেবাশিস সোমকে। ইতিমধ্যে আর জি করে আর্থিক দুর্নীতির মামলাতেও ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিলের সদস্য দেবাশিস সোমের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই, চলে জেরাও। তারপরেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন দেবাশিস সোম। বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসাপাতালে ভর্তি ছিলেন বেশকিছুদিন। গত চারদিন আগ হাসপাতাল থেকেও ছাড়াও পান। কিন্তু তারপর তিনি কোথায় নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তাঁকে ফোনেও পাওয়া যায়নি।
সিবিআই হেপাজতে জেরাতেই সন্দীপ ঘোষকে লাগাতার জেরায় দেবাশিস সোম সম্পর্কেও একাধিক তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে সিবিআই-র একটি সূত্রে জানা গেছে ভ্যাজাইনাল সোয়াব ও ব্লাড সহ নমুনা যা সংগ্রহ করা হয়েছিল তা পরিকল্পিত ভাবে দু’দিন পরে সিএফএসএল’এ পাঠানো হয়। এবং সেখানেও এই দেবাশিস সোম ও সন্দীপ ঘোষের জুটি কাজ করেছে। কীভাবে ? ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি প্রধান বিচারপতিকে জানান ভ্যাজাইনাল সোয়াব ও ব্লাড সাধারণ ভাবে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সংরক্ষণ করা উচিত তাও করা হয়নি। যার ফলে সেই নমুনা নষ্ট বা নমুনার সংমিশ্রন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে দেবাশিস সোম ও সন্দীপ ঘোষের জুটি এই নমুনা পাঠাতে বিলম্ব করেছিল পরিকল্পিত ভাবে। মাঝের দু’দিন যথাযথ ভাবে তা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সংরক্ষণও করা যায়নি যার ফলে নমুনার সংমিশ্রণ ঘটে। এটা তথ্য প্রমাণ লোপাট ও বিকৃত করার পরিকল্পনারই অংশ।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গোটা এই তথ্য প্রমাণ লোপাটে দেবাশিস সোম যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে সন্দীপ ঘোষকে। সেদিন সকালে তিনি ঘটনাস্থলেও চলে এসেছিলেন দ্রুত। দফায় দফায় সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসির সঙ্গে তিনি কথা বলেন। ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়াতেও নজরদারি রাখেন। ময়নাতদন্তকারী দলে ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের অধ্যাপক অপূর্ব বিশ্বাস, সহকারি অধ্যাপক রিনা দাস এবং এন আর এসের সহকারি প্রফেসর মলি বন্ধ্যোপাধায়কে। তাঁদের সঙ্গে সেদিন রাতে ময়নাতদন্ত শেষে আলোচনাতেও বসেন দেবাশিস সোম। কিন্তু কেন? কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, আর জি করের দুর্নীতিতেও এই ব্যক্তির ভূমিকা গুরুতর ভাবে সামনে এসেছে। জেরাও করা হয়েছে একদফায়। তারপর অসুস্থ হয়ে যান বলে দাবি করেছেন। এবার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাতেও এই চিকিৎসককে জেরা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিবিআই।
এদিকে আর জি করে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের পাশে দাঁড়ালো কলকাতা পুলিশ। সহকর্মীর বিপদের দিনে পাশে থাকাই স্বাভাবিক বলেই দাবি পুলিশের। কিন্তু এমন নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার পাশে দাঁড়ানো কলকাতা পুলিশের হাতে আর জি করে তদন্তের চেহারা কী হতো তা নিয়েও এবার প্রশ্ন উঠে গেল। সোমবার দুপুরে অভিজিৎ মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা। ছিলেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (চতুর্থ) ভি সলোমন নিশা কুমার, ডেপুটি কমিশনার (এসএসডি) যাদবপুর বিদিশা কলিথা এবং ডেপুটি কমিশনার (ইস্ট ডিভিসন) আরিশ বিলাল। পরে ভি সলোমন নিশা কুমার সাংবাদিকদের কাছে বলেন ‘ ব্যক্তিগত ভাবে আমি করি বিশ্বাস অভিজিতের কোনও দোষ নেই। যত দ্রুত সম্ভব ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন উনি। স্বচ্ছ তদন্তের জন্য যা যা করা দরকার, সবই তিনি করেছেন।’ সিবিআই ধর্ষণ ও খুনের মামলায় টালা থানার ওসিকে গ্রেপ্তার করার পরেও খোদ কলকাতাকলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সাংবাদিকদের সামনে দাবি করছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন না টালা থালার ওসি যুক্ত। একজন শীর্ষ পুলিশ আধিকারিক হিসাবে তদন্ত চলাকালীন এমন মন্তব্য করা যায়? এমন ঘটনায় অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ- এটাও নজিরবিহীন। সিবিআই-র তরফে আদালতে জানানো হয়- ধৃত টালা থানার ওসি মূল ঘটনা অর্থাৎ ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে তথ্য প্রমাণ লোপাট ও বিকৃত করার ষড়যন্ত্রের অংশ’। ফলে কলকাতা পুলিশের সিট’র হাতে তদন্ত থাকলে তাহল কী হতে পারতো আর জি করে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তের চেহারা তা বলাইবাহুল্য। এদিন ধৃত অভিজিৎ মণ্ডলের স্রীবেও জানান লালবাজার তাঁদের পরিবারের পাশে আছে। এদিন দুপুরে সিবিআই দপ্তরেও আসেন তিনি। সিবিআই তাঁর সঙ্গে কথাও বলেন। কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন তাঁর কাছেও।
Comments :0