অনিন্দ্য হাজরা
মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা ২ ব্লকের আখেরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত। গ্রাম পঞ্চায়েতের একদম উত্তর প্রান্তে নির্মল চর। পদ্মার উপরে জেগে থাকা ধূসর ভূমিখণ্ড। মূল জেলা থেকে এই চরে যাওয়ার কোনও পাকা সেতু নেই। রয়েছে পলকা ছিটে বেড়ার সাঁকো। নির্মলচরের বঞ্চনা এখানেই শেষ নয়। গোটা চর জুড়ে নেই পাকা সড়ক। বামফ্রন্টের সময়কালে রাস্তায় মোরাম পড়লেও এখন রাস্তা না ডোবা, ঠাহর করা কঠিন।
গঙ্গার ভাঙনে বিপর্যস্ত এই ব্লকের পঞ্চাতেত সংখ্যা ৭ থেকে কমে হয়েছে ৬।
অদ্ভুত এই ‘নেই রাজ্য’।
এই নেই রাজ্যে সরকার নাগরিক পরিষেবা দিতে পারুক আর না পারুক, 'বেয়াড়া' নাগরিককে জব্দ করতে কোনও ফন্দি বাদ দেয় না। কারণ, গোটা ভগবানগোলা-২ ব্লকে একমাত্র এই পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করতে পেরেছে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস।
আখেরিগঞ্জে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করেছেন বামপন্থীরা। কংগ্রেসের সমর্থনে। প্রধান হয়েছেন শাহেনশাহ শেখ। শুক্রবার তাঁর বাড়িতেই দুপুরের খেয়েছেন এই লোকভা কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। সেই সময় গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন কবিরুল ইসলাম।
জঙ্গীপুর অঞ্চলের এক স্কুলের শিক্ষক কবিরুলের কথায়, পঞ্চায়েতের ১৮ আসনের মধ্যে সিপিআই(এম) প্রার্থীরা জয়ী হয় ৯ আসনে। কংগ্রেস ২টিতে। বাকি ৭টি’র মধ্যে তৃণমূল ২টো বুথে জিতেছে ভোট লুট করে। দুটি বুথই নির্মল চরের।
তৃণমূলের তাহলে এই অঞ্চলে বিশাল দাপট?
কবিরুলের কথায়, তৃণমূল এখানে লোক বের করতে সাহস পায় না। গোটা এলাকা সিপিআই(এম)'র। কিন্তু তৃণমূলের হয়ে ভাড়া খাটে পুলিশ।
সেই ভাড়া খাটার সাক্ষী গোটা গ্রামের মানুষ। বোর্ড গঠনের আগে নির্বাচিত সদস্যদের রক্ষা করতে হাজী রিয়াজুদ্দিনের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি পঞ্চায়েতের প্রধান, ব্লকের সহ সভাপতিও ছিলেন। এইবারে জেলা পরিষদে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গণনায় হারানো হয়েছে।
অভিযোগ, বোর্ড গঠন আটকাতে, বোর্ড গঠনের রাতেই প্রথমে ফোন আসে রানীতলা থানার আইসি'র। কবিরুলকে বলা হয়, হোয়াটস্যাপে কল রিসিভ কর। পরামর্শ দেওয়া হয়, রাতের মধ্যে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরে নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। হুমকিতে কাজ না হওয়ায়, পরেরদিন হাজি রিয়াজুদ্দিনের বাড়িতে এসে ভাঙচুর চালায় লালবাগের এসডিপিও স্বয়ং। দুপুরে খেতে বসা বৃদ্ধ গ্রামবাসীদের ঠাসিয়ে চড়। বোর্ড গঠনের খবর আটকাতে স্থানীয় সাংবাদিকদের এলাকায় প্রবেশ আটকানো হয় ১৪৪ ধারার নোটিশ দেখিয়ে।
তাতেও কাজ হয় না যদিও। কারণ পুলিশ জান প্রাণ দিয়ে জোড়াফুলের হয়ে খাটলেও আসল সময়ে রণে ভঙ্গ দেয় তৃণমূল।
এদিন মহম্মদ সেলিমকে ঘিরে ধরে গ্রামবাসীদের একটাই আবেদন, আপনি পুলিশের দাপাদাপি আটকে দিন, আমরা এই পঞ্চায়েত থেকে আমরা আড়াই হাজার ভোটের লিড দেব।
পুলিশ-তৃণমূলের নিঁখুত বোঝাপড়ার চমকে দেওয়ার মতো সাক্ষী সানারুল ইসলাম শেখ। ভগবানগোলা-২ নম্বর ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সিপিআই(এম) সদস্য। নিজের ভোটটাও দিতে পারেননি। পুলিশ 'এলাকা খালি' করতে তুলে নিয়ে গিয়ে ৩ দিন পরে খালাস করেছে। তারপরেও জিতেছেন।
সানারুলের কথায়, “আমাদের পঞ্চায়েত প্রার্থীদের থেকে রানীতলা থানার পুলিশ ১০-১৫ হাজার করে টাকা দাবি করেছে, কেন জানেন? বলেছে টাকা দে, তাহলে সব ভোট লুটতে দেব না!”
ভগবানগোলার এই অঞ্চলগুলিতে ২০১৩'র পঞ্চায়েত নির্বাচনেও সিপিআই(এম) জয়ী হয়েছিল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার তিনটি স্তরেই। তারপরে শুরু হয় পুলিশের অকথ্য অত্যাচার। গ্রামবাসীদের দাবি, পরিচিত সিপিআই(এম) নেতাদের লক আপে ঢুকিয়ে বিবস্ত্র করে পিটিয়েছিল পুলিশ। একাধিকজনের মূত্র নালি দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল পুলিশের মারে।
মার, মিথ্যা মামলা, পানি কেস, বাড়ি ভাঙচুর- বহু মানুষকে বাধ্য করেছিল তৃণমূলের পতাকা ধরতে। তাঁরা ফের কাস্তে হাতুড়ির ছায়ায় ফিরছেন। পথসভায় গর্জন শোনা যাচ্ছে, “বাঁচতে হলে তৃণমূলের লোকেদের হয় লাল ঝান্ডা নিতে হবে, নইলে কংগ্রেস করতে হবে”।
বেকায়দায় পড়া তৃণমূলের শেষ অক্সিজেন সেই পুলিশ। গ্রামবাসীরা বলছেন, শুক্রবারই আখেরিগঞ্জের এক সিপিআই(এম) সমর্থককে লালবাগের এসডিপিও সাট্টার বোর্ড চালানোর 'অভিযোগে' তুলতে এসেছিলেন। যদিও পালটা চাপ পড়ে। তিনি বলেছেন, আমি তো থানায় ডাকিনি। ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়েছি।
নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ, নির্বাচনী ব্যবস্থার কোনও অংশ হতে পারবে না সিভিক ভলান্টিয়াররা। তবুও তারা এলাকায় ঘুরছে, এবং পরিচিত সিপিআই(এম)-কংগ্রেসের সমর্থকদের চমকাচ্ছে। ভগবানগোলা, হরিহরপাড়া, ডোমকল, রানীনগর- এই অভিজ্ঞতা সর্বত্র।
মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিআই(এম) নেতৃত্ব জানিয়েছেন, রানীতলা সহ লাগোয়া ৪টে থানার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ জানানো হয়েছে একাধিকবার। বিজেপি’র দুর্বল জায়গায় তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলার মতো পদক্ষেপ এখনও নিতে দেখা যায়নি কমিশনকে।
শেষ সম্বল হিসেবে তৃণমূল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৫০০ কিংবা হাজার টাকার নোট গুঁজে দিচ্ছে হাতে। তার জবাবে মহিলারাই বলছেন, “আবাস থেকে শুরু করে শৌচাগার, সব লিয়ে গেল টিএমসি। এখন ৫০০ টাকা দিয়ে তার ভরপাই হবে?”
MURSHIDABAD NIRMALCHAR
‘সব লিয়ে গেল টিএমসি, এখন ৫০০ টাকায় ভরপাই হবে?’
×
Comments :0