লব মুখার্জি: খড়দহ
পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডারাজ খতম করার জন্য মায়েদের টিম তৈরি হবে পশ্চিমবাংলার প্রতিটি বুথে। বাংলাকে যদি বাঁচাতে হয় নিজের পরিবার, নিজের সমাজ, নিজের বুথকে বাঁচাতে হবে। মেয়েদের কোমর বেঁধে দাঁড়াতে হবে। রবিবার খড়দহে এক বিরাট মহিলা সমাবেশে এই আহ্বান জানিয়েছে নেত্রীবৃন্দ। সমাবেশে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় নেত্রী দেবলীনা হেমব্রম বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন সন্ধ্যের পরে মেয়েরা বাইরে বেরোবে না। বিজেপি এবং তৃণমূলকে তাড়াতেই হবে, এটাই আমাদের লক্ষ্য। সমাবেশে গণআন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, স্বাস্থ্য, মেধা, মেহনত, অধিকার বাঁচাতে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় সকলকে রাস্তায় থাকতে হবে। রাজনৈতিক আনুগত্য না থাকলে মানুষের কোনও নিশ্চয়তা থাকবে না? এটা কি সরকার চলছে? আমার টাকায়, আমার ভোটে, যে সরকারকে নির্বাচিত হয়েছে, তারাই আমাদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
খড়দহ রবীন্দ্র ভবনের সামনে এদিন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ উপলক্ষে এই বিরাট মহিলা সমাবেশ হয়। দেবলীনা হেমব্রম, মীনাক্ষী মুখার্জি ছাড়াও প্রকাশ্য সমাবেশে অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক রুনু ব্যানার্জি, মহিলা নেত্রী সোমা দাশ, অভ্যর্থনা সমিতির যুগ্ম সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস। সমাবেশ পরিচালনা করেন সংগঠনের জেলা সভাপতি যশোধরা বাগচী।
এদিন সমাবেশে দেবলীন হেমব্রম বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভয় ধরেছে, উনি এখন ভাবছেন যদি ভুয়ো ভোট রাখতে না পারি, তাহলে বিপদ হবে। দেশের সরকার এবং রাজ্য সরকার যে নির্যাতন এবং শোষণ করছে তার বিরুদ্ধে একমাত্র বামপন্থীরা এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি প্রতিবাদ করছে। দেবলীনা হেমব্রম বলেন, জোর করে তৃণমূলের মিছিলে নিয়ে যাওয়া এখন আর অনেকেই মেনে নিচ্ছে না। আগামী দিনে আরও অনেকে ওদের ফতোয়া অমান্য করবে। তালডাংরার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের সমাবেশে মানুষ বেশি হলে পুলিশের সবচেয়ে বেশি জ্বালা ধরে। পুলিশ ছাড়া তৃণমূল কিছু করতে পারে না। তিনি বলেন, ১০০ দিনের কাজ সংগ্রাম করে বামপন্থীদের নেতৃত্বেই নিয়ে আসা হয়েছিল। আমাদের সাংসদরা শর্তভিত্তিক সমর্থন দিয়ে ১০০ দিনের কাজের দাবি করেছিলেন। এখন বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধ করে সেই টাকা আটকে দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা ফেরতের সংগ্রামও আমরাই করেছি। আগামী দিনের বড় লড়াইয়ে মানুষের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিকল্পনা করে মানুষকে ভাগ করছে বিজেপি এবং তৃণমূল।
এদিন মীনাক্ষী মুখার্জি সমাবেশে বলেন, বাংলা এবং সমাজকে বাঁচানোর লড়াই করার রূপরেখা তৈরি করেছে মহিলা সমিতি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আরও বেশি মহিলাকে শামিল করার জন্য কাজের ধারার পরিবর্তন করা হচ্ছে। সমস্যায় জর্জরিত আইসিডিএস, স্বাস্থ্যকর্মী, পঞ্চায়েতের কর্মী, প্রকল্প কর্মীদের নিয়ে সংগঠন করা হবে। নিজেদের নামটা কাজে রাখার জন্য, মাইক্রোফিনান্সের ঋণ নিয়ে এবং নিজের টাকা দিয়ে সেন্টার চালাতে হচ্ছে আইসিডিএস কর্মীদের। কাজের ধারার পরিবর্তন করে, মহিলা সমিতি তাঁদের পাশে থেকে রাস্তার লড়াই করবে।
বিজেপি তৃণমূলকে সমস্যায় ফেলবে একথা বলে যাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্যে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, দিল্লিতে বসে থাকা বিজেপি-কে জবাব দিতে হবে, ১০০ দিনের কাজের দুর্নীতি ধরার জন্য এত টিম এলো, পঞ্চায়েতে গেল, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে একটাও মামলা হলো না কেন? একটা কোনও সঙ্গত বিচার করছে বিজেপি?
এই প্রশ্ন করে, আর জি করে অভয়ার উপরে নির্যাতন এবং খুনের ঘটনার উল্লেখ করে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, একজনকে আসামী সাজিয়ে তাকে ফাঁসির জন্য রাজ্য পুলিশের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। সিবিআই চার্জশিট একইভাবে ওই ব্যক্তিকেই আসামী করে সবকিছু চাপা দিতে চাইছে। সাধারণ বুদ্ধি, বিজ্ঞানসম্মত বিষয়, পুলিশ-সিবিআই-সরকার চাইছে না একসাথেই। কেন্দ্রের নেতা-মন্ত্রীরা অভয়ার মা, বাবার সাথে একবারও দেখা করলো না কেন? এটা কি রাজ্যের বিজেপি নেতারা চাননি? খুন ধর্ষণের দুর্নীতির মুখোশ টেনে খুলে, যারা অপরাধ আড়াল করার জন্য অনেক কিছু করলো তাদের সামনে নিয়ে আসতে দেশের বিজেপি সরকারের অসুবিধে কোথায়? একজনকে বলির পাঁঠা করে সবকিছু ধামা চাপা দিতে বিজেপিও এগিয়ে এলো কেন? আমড়া গাছে যেমন আম হয় না, তেমনি বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। আরএসএস নেতা পশ্চিমবাংলায় এসে বলে গেছেন, মমতা ব্যানার্জি আর জি করের ব্যাপারে যা করবেন সেটাই ঠিক। যারা মনে করছেন, বিজেপি নাকি তৃণমূলকে শায়েস্তা করে দেবে, তাদের এটা বুঝতে হবে।
মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, তামান্নার মা, সুদীপ্তর দিদি আপনাদের লড়াইটা করে দিতে পারবে না। আপনাদের নিজেদের লড়াই নিজেদেরই করতে হবে। তিনি বলেন, পশ্চিমবাংলায় অনুব্রত, শাহজাহান, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, পার্থ চ্যাটার্জির মতো কয়লা চোর, গোরুচোর, চাকরিচোর, চালচোর অপরাধীরাই বর্তমানে নেতা।
মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, হঠাৎ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী কমে গেল কেন? দেখা যাচ্ছে ওই ছাত্ররা, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে তার বাবার সাথে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে, কেউ রিল বানাচ্ছেন, আবার কেউ লোকের বাগানবাড়ি পরিষ্কার করছেন। তিনি বলেন, পশ্চিমবাংলায় সমাজের উন্নতির রেখাচিত্রকে তুলে ধরেছিল বামপন্থীদের পরিচালিত সরকার।
এদিন সমাবেশের শুরুতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন অসীম ব্যানার্জি এবং সহশিল্পীরা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, খড়দহ শাখা এবং সৃজন শাখার শিল্পীরা, শ্রুতি নাটক ‘আকাশের ঠিকানা’ পরিবেশন করেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির বিধাননগর ১ লোকাল কমিটি।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির প্রতিনিধি সম্মেলনের তৃতীয় ও শেষদিনে, নারী সহ রাজ্যের মানুষের দাবিগুলিতে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র সমর্থনে প্রস্তাব উত্থাপন করেন সোমা দাশ। প্রস্তাবকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন আত্রেয়ী গুহ। প্রতিনিধিদের আলোচনার জবাবী ভাষণ দেন রুনু ব্যানার্জি। সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবেদন গৃহীত হয়। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মহিলা নেত্রী অঞ্জু কর। সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য স্বপ্না ভট্টাচার্য। বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক বাবন সরকার। সম্মেলন থেকে গঠিত হয়েছে ৭০ জনের জেলা কমিটি এবং ২৯ জনের জেলা সম্পাদকমন্ডলী। যশোধরা বাগচী সভাপতি এবং রুনু ব্যানার্জি সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কোষাধ্যক্ষ এবং পত্রিকা ইনচার্জ হন যথাক্রমে পূরবী সরকার ও স্মৃতি কর। জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিলেন ৪৩৭ জন, দর্শক ছিলেন ২৫জন।
Comments :0