দীপশুভ্র সান্যাল, জলপাইগুড়ি
পাড় ভাঙতে ভাঙতে স্কুলের একেবারে কাছে চলে এসেছিল তিস্তা। স্কুল বাড়ির থেকে দূরত্ব দাঁড়িয়েছিল মাত্র কুড়ি ফুট। এবার জল ঢুকেই গেল কানাইনগর নিউ প্রাইমারি স্কুলে। এই এলাকায় আগেই তলিয়ে গিয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি। দলে দলে সরে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। নতুন এলাকায় স্কুল বানানোর জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষক। না হ’লে বন্ধ হয়ে যাবে এলাকার শিশুদের পড়াশোনা।
জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের নন্দনপুর বোয়ালমারী এলাকার বাহের চর বলে পরিচিত এলাকা এবারে বর্ষার প্রথমেই ভাঙতে শুরু করে। চরের এই অংশে আইসিডিএস সেন্টার তলিয়ে যায়। আশঙ্কা ছিল যে দু-একদিনের মধ্যে তলিয়ে যাবে গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক স্কুল কানাইনগর নিউ প্রাইমারি স্কুল। শুক্রবার বিকেলে জল ঢুকেই গেল স্কুলবাড়িতে।
চারজন শিক্ষক এবং ৫০ জনের কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী রয়েছে স্কুলে। এবছর আরো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু হয়েছিল। তিস্তার ভাঙনে স্কুল তলিয়ে যাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে চিন্তিত সকলে।
ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হরিপদ রায় পরিস্থিতি বিশদে জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন জলপাইগুড়ি সদর সাউথ সার্কেলের এসআই-কে। তাঁর আবেদন, স্কুলবাড়ি এবং আসবাব সরানো ছাড়া গতি নেই। গ্রামের বাসিন্দারাই সরে যাচ্ছেন দু-তিন কিলোমিটার দূরে অন্য এলাকায়। শিশুরাও চলে গিয়েছে অন্যত্র। এই স্কুলে শিশুরা পড়তে আসবেই বা কিভাবে, তোলা হয় সেই প্রশ্নও। এবার স্কুলে জল ঢুকে যাওয়ায় প্রশাসনের অপেক্ষায় বাহের চর। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা করার আর কোনও উপায়ই নেই।
শুখা মরসুমে সদর ব্লকের মন্ডল ঘাট সংলগ্ন নন্দনপুর বোয়ালমারী গ্রাম পঞ্চায়েতের এই অংশের মূল ভূখণ্ড থেকে তিস্তার চর দিয়ে হাঁটা পথে যাওয়া গেলেও বর্ষার চার মাস এই গ্রামে প্রবেশ করতে হয় ময়নাগুড়ি হেলা পাকরি হয়ে ভুটভুটিতে তিস্তা পেরিয়ে।
বাহের চর এলাকায় প্রায় ১২০০’র কাছাকাছি মানুষের বাস। মূলত বাদাম, আলু, মরসুমি সবজি চাষ হয়। তিস্তার চরের জমিতে চাষ করে ফসল ফলায় প্রায় সাড়ে ৩০০ কৃষক পরিবার। সম্প্রতি যে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তিস্তার জলে চলিয়ে গেছে, জানা গেছে, সেই কেন্দ্র থেকে এলাকার প্রায় তিনশো মা ও শিশু প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার পেতেন। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী আইসিডিএস সেন্টার তলিয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত সরকারি তরফের কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য জিতেন দাস ক্ষোভের সুরে জানান বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে তিস্তার বিভিন্ন চর এলাকার গ্রামগুলিকে রক্ষা করার জন্য ‘চর বাঁচাও কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। ২০১১-তে তৃণমূল সরকারে আসীন হওয়ার পর এই উদ্যোগ আর নেই।
স্থানীয় কানাই নগর পাড়া নিউ প্রাইমারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হরিপদ রায় গত কয়েক দিন ধরে খরস্রোতা তিস্তা নদী পেরিয়ে ময়নাগুড়ি হয়ে ভুটভুটিতে স্কুলে পৌঁছে গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে স্কুল বাঁচানোর জন্য প্রচেষ্টা নিলেও বাস্তব পরিস্থিতি এই মুহূর্তে তিস্তা কানাইনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়কে প্রায় গিলে নিয়েছে।
নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক বিপ্লব ঝা জানান যে গত কয়েক বছর ধরে স্কুল রক্ষার জন্য বারবার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেচ দপ্তরের এক কর্মী জানান তাঁরা বিষয়টি দেখেছেন। কিন্তু সরকারি কোনও নির্দেশ না এলে কিছু করার নেই।
সরকারি সাহায্য না পেয়ে গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে ঘরবাড়ির ছেড়ে সরে যাচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ কৃষক পরিবারেরই চরের এইটুকু জমি ছাড়া কিছুই নেই। শুধু প্রতিশ্রুতিই সার। সরকারি তরফে গত ১২ বছরে চর বাঁচানোর জন্য কোনও প্রচেষ্টা নেই।
তিস্তা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে গত কয়েক মাসে কয়েক দফা বৈঠক হলেও কখনই চর এলাকার বাসিন্দাদের বাঁচানোর প্রসঙ্গ উঠে আসেনি কেন, ক্ষোভ স্থানীয় বাহের চর এলাকার গ্রামবাসীদের।
Comments :0