Biometric Ration

বায়োমেট্রিক জাঁতাকলে গরিব বাদ রেশন থেকে

রাজ্য

Biometric Ration

মিলছে না আঙুলের ছাপ। রেশন প্রাপ্তি থেকে ক্রমশ ছিটকে যাচ্ছেন গরিব মানুষ। 
‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ চালু করেছে মোদী সরকার। বাধ্যতামূলকভাবে ডিজিটাল রেশন কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে আধার কার্ড। এখন রেশন দোকানে গিয়ে আঙুলের ছাপ মেলার পরেই পরিবারের প্রাপ্ত চাল-গম পাওয়া যায়। আর আঙুলের ছাপ দিতে গিয়েই ছাপ না মেলায় রেশন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছেন গরিব মানুষ। 
মোদী সরকারের শর্ত মেনে এরাজ্যে আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ডের সংযুক্তি ঘটিয়ে প্রায় ২ কোটির ওপর রেশন কার্ডকে চিরতরে বাতিল করেছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর। খাদ্য দপ্তর সূত্রের ব্যাখ্যা, বাতিল হওয়া কার্ডের অধিকাংশই মৃত ব্যক্তি। তার সঙ্গে ব্যাপক হারে ভুয়ো রেশন কার্ড বাতিল হওয়ার ফলে রাজ্য সরকার রেশন খাদ্য সামগ্রীতে প্রচুর টাকা সাশ্রয় করতে পারছে। ফি মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা কার্ড বাতিল থেকে বাঁচাতে পারছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেশন তুলতে গিয়ে কার্যত নাকাল হতে হচ্ছে গ্রাহকদের। আঙুলের ছাপ প্রায়শই যাচাই না হওয়ার জন্য সক্রিয় কার্ড অনলাইন সিস্টেমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় রেশন থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। যাঁদের সিংহভাগই গরিব মানুষ। 
এক সময় এরাজ্যে প্রায় ১০ কোটি ৫৬ লক্ষ রেশন কার্ডের গ্রাহকের অস্তিত্ব ছিল। আধারের সঙ্গে ডিজিটাল রেশন কার্ডের সংযোগ করার পর এখন রেশন কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫৬ লক্ষের কাছাকাছি। ফলে সরাসরি ২ লক্ষ রেশন কার্ড বাতিল হওয়ার ফলে রাজ্যের বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা বাঁচছে। ২০২১-২২ সালে খাদ্য দপ্তরের বাজেট বরাদ্দ থেকে গত ২০২২-২৩ সালে ৩২০০কোটি টাকা কমানো হয়েছে। সরকারের আর্থিক সুবিধা হচ্ছে। অন্যদিকে আঙুলের ছাপ না মেলায় গরিব বঞ্চিত হচ্ছে রেশন থেকে। 
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেশন চালু হওয়ার সময়েই আঙুল ছাপ না মেলার আশঙ্কার প্রশ্ন সামনে এসেছিল। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ, গৃহ পরিচারিকার কাজে যুক্ত মহিলাদের যে ধরনের কাজে নিত্যদিন যুক্ত থাকতে হয়, তাতে ছয় মাসের মধ্যেই আঙুলের ছাপের পরিবর্তন ঘটে যায়। আঙুলের ছাপ দিয়ে রেশন তুলতে গিয়ে সবথেকে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে রাজ্যের আদিবাসী নিবিড় এলাকাগুলিতে। আঙুলের ছাপ না মেলায় রেশন থেকে সাময়িক ছিটকে যাচ্ছেন বয়স্ক গ্রাহকরাও। 
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার এক কলোনির বাসিন্দার বক্তব্য,‘‘ রেশন তুলতে গিয়ে আঙুলের ছাপ মেলেনি। ফলে রেশন পাওয়া যায়নি। যেতে হয়েছিল সরকারি রেশন অফিসে। নতুন করে আধার আপডেট করে বন্ধ রেশন কার্ডকে আবার চালু করতে হয়েছে।’’ বন্ধ হয়ে যাওয়া রেশন কার্ডকে ফের সক্রিয় করতে ন্যূনতম দু’মাস সময় পার হয়ে যায়। ওই সময়কালে চালের প্রয়োজন মেটাতে হয় খোলা বাজার থেকেই। রেশন থেকে বাদ পড়ে ফের খোলা বাজারের চড়া দরে চাল-গম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন গরিব মানুষ। রেশন ডিলাররাও মানছেন এই সঙ্কটের কথা। তাঁদের বক্তব্য,‘‘ রেশন তুলতে এসে অনেক সময়ই আঙুলের ছাপ মিলছে না। ফলে আমারও গ্রাহককে রেশন দিতে পারছি না। ফের রেশন কার্ডকে সক্রিয় করার জন্য গ্রাহকদের যেতে হচ্ছে রেশন দপ্তরে।’’
শুধু যে রেশন তুলতে এসে আঙুলের ছাপ মিলছে না এমনটা নয়। আঙুলের ছাপ মেলার পরেও পরিবারের অনেক সদস্যেরই রেশন কার্ড সিস্টেমে নিষ্ক্রিয় থেকে যাচ্ছে। ফলে পাঁচ জনের পরিবারের রেশন তুলতে এসে দুজনের কার্ড সিস্টেমে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য তিনজনের প্রাপ্য রেশন নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে গ্রাহকদের। খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই ধরনের সমস্যার মুখে শুধুমাত্র এরাজ্যে নিজস্ব খাদ্য সুরক্ষা যোজনা আরকেএসওয়াই ১ রেশন কার্ডের গ্রাহকদেরই পড়তে হচ্ছে। খাদ্য দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ পাঁচ বছরের নিচে ও ৬০ বছর অতিক্রম করা বয়স্ক গ্রাহকদের রেশন কার্ড সিস্টেমে ব্লক হয়ে যাচ্ছে। রেশন কার্ড গ্রাহকদের একটা বড় অংশই এখন এই সমস্যায় পড়ছে।’’ পরিবারের কোনও এক সদস্যের কার্ড ব্লক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর জন্য বরাদ্দ রেশন সামগ্রী মিলছে না। তখন শিশু হলে আধার কার্ড থাকলে নিয়ে যেতে হচ্ছে রেশন অফিসে। আধার কার্ড না থাকলে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মের শংসাপত্র দাখিল করতে হচ্ছে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে আধার কার্ড নিয়ে যেতে হচ্ছে। আধার কার্ড আপডেট করতে হচ্ছে। নতুন করে আঙুলের ছাপ দিয়ে আবার যাচাই করতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা থেকে সাময়িক অব্যাহতি মিলছে। ফের তিন চার মাস পরে আবার কার্ড ব্লক হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরাই। নতুন করে আধার কার্ড আপডেট করে রেশন চালু করতে ন্যূনতম দুই থেকে তিন মাস সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওই পর্বে কোনোভাবেই মিলছে না রেশন।  
এখন গোটা দেশের সঙ্গে এরাজ্যেও রেশন ব্যবস্থার গোটা প্রক্রিয়ায় চালু হয়েছে অনলাইন। নির্ধারিত দিনে রেশন দোকানে এসে আঙুলের ছাপ যাচাই হওয়ার পরই মেলে প্রাপ্য চাল, গম থেকে আটা। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় এরাজ্যে ৬ কোটি রেশন গ্রাহক আছেন। তার বাইরে রাজ্যের খাদ্যসাথী প্রকল্পে আরকেএসওয়াই ১ ও আরকেএসওয়াই ২ এই ধরনের রেশন কার্ডে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি রেশন গ্রাহক আছেন। তার মধ্যে ২কোটি আরকেএসওয়াই ১ ও ৫০ লক্ষের কাছাকাছি আরকেএসওয়াই ২ রেশন কার্ডের গ্রাহক। 
আরকেএসওয়াই রেশন কার্ডের গ্রাহকদের জন্য খাদ্য দপ্তর কার্ড পিছু ৩কেজি গম ও ২ কেজি চাল বরাদ্দ করেছিল। একইভাবে আরকেএসওয়াই ২ রেশন কার্ডের গ্রাহকদের জন্য কার্ড পিছু ১কেজি চাল ও ১কেজি গম দেওয়া হতো। কিন্তু গমের সরবরাহ কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ করে দেওয়া জন্য রাজ্যকে খোলা বাজার থেকে গমের পরিবর্তে চাল দিতে হচ্ছে। কিন্তু কার্ডই যদি নিষ্ক্রিয় (ব্লক) হয়ে যায়, তাহলে বরাদ্দের সামগ্রী মিলবে কী করে?
 

Comments :0

Login to leave a comment