RATION SCAM

মন্ত্রী বালুর পরিবারকে ৯ কোটি দিয়েছেন বাকিবুর

রাজ্য জেলা

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP ration scam

গ্রেপ্তারির আগে পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমের সামনে রেশন দুর্নীতিতে ধৃত মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছিলেন, ‘‘কে বাকিবুর, আমি চিনিই না। অনেক লোকই তো আমার ঘনিষ্ঠ। রথীন ঘোষও তো আমার ঘনিষ্ঠ।’’
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বাকিবুর রহমান বলে কাউকে চিনতেন না বলে দাবি করেছিলেন। রেশন দুর্নীতিতে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও বাকিবুর দু’জনেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এবার আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি দাবি করল, তদন্তে যে তথ্য সামনে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, খাদ্য মন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বাকিবুর রহমানের কাছ থেকে ৯ কোটি টাকা পেয়েছিলেন!
ধৃত বাকিবুর রহমান ধৃত খাদ্য মন্ত্রীকে ৯ কোটি টাকা দিয়েছিলেন! মূলত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রী ও কন্যাকেই ৯ কোটি টাকা দিয়েছিলেন রেশন দুর্নীতিতে ধৃত বাকিবুর রহমান! এক জন চালকলের মালিক রাজ্যের খাদ্য মন্ত্রীর স্ত্রী ও কন্যাকে কোনওরকম নথি ছাড়াই ৯ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন! তদন্তকারী সংস্থার দাবি, বালুর স্ত্রী এবং কন্যাকে সুদ ছাড়াই নয় কোটি টাকা ‘লোন’ দিয়েছেন চালকল ব্যবসায়ী ও রেশন দুর্নীতির অন্যতম পাণ্ডা বাকিবুর রহমান। সেই ঋণের জন্য বন্ধক হিসাবেও কিছু ছিল না।
অথচ ৫৫ ঘণ্টা ধরে বাড়িতে তল্লাশি ও জেরা শেষে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট যখন গত ১৩ তরিখে বাকিবুর রহমানকে রেশন দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার করে, সেই দিনই সাংবাদিকদের সামনে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেন, তিনি বাকিবুর রহমান বলে কাউকে চেনেনই না। তবে ইতিমধ্যে মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাস সংবাদ মাধ্যমের সামনেই স্বীকার করেছেন যে, ২০১৪ পর্যন্ত যখন তিনি আপ্ত সহায়ক হিসাবে কাজ করেছেন, তখনই একাধিকবার মন্ত্রীর কাছে বাকিবুর রহমানকে আসতে দেখেছেন, মন্ত্রীর সঙ্গে বাকিবুরের ঘনিষ্ঠতাই ছিল।
সেই ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ হিসাবেই এদিন আদালতে ইডি’র তরফে বাকিবুরের তরফে ধৃত মন্ত্রীর পরিবারকে ৯ কোটি টাকা ‘লোন’ দেওয়ার তথ্য সামনে আনা হয়, যদিও সেই টাকা শোধও করা হয়নি। আগামী ১৩ তারিখ আবার আদালতে তোলা হবে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। তার আগে এদিন বাকিবুরের সঙ্গে তাঁর পরিবারের আর্থিক লেনদেনের তথ্য আদালতে পেশ করা রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ। মন্ত্রীর পরিবারকে ৯ কোটি টাকা ধার দেওয়ার প্রসঙ্গেই বাকিবুরকে ফের জেলে গিয়ে জেরা করতে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে এদিন আবেদনও জানায় ইডি। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে। একইসঙ্গে বাকিবুরকে আগামী ২২ নভেম্বর পর্যন্ত জেল হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এদিকে আদালতে যখন বালু ও বাকিবুরের আর্থিক ঘনিষ্ঠতার তথ্য সামনে আনছে ইডি, সেই সময়েই সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি’র দপ্তরের বাইরে সাংবাদিকদের সামনেই মন্ত্রীর ভুয়ো কোম্পানির কারবার নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ আনেন মন্ত্রীর বাড়ির পরিচারক রামস্বরূপ শর্মা। একসময়ে স্যালোন ছিল, পরে মন্ত্রীর বাড়ির পরিচারকের কাজ করেন রামস্বরূপ শর্মা। কৃষি দপ্তরের অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল রামস্বরূপ শর্মাকে। শুক্রবারের পরে শনিবারও তাঁকে সিজিও কমপ্লেক্সে জেরা করে ইডি। এদিন সেই জেরা শেষে বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে এই ব্যক্তি দাবি করেন, ‘‘সাহেবের (জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক) নাম করে কয়েক জন আমার কাছে সই করাতে আসে। সাদা কাগজে তাঁরা আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নেয়। কিন্তু কীসের জন্য, তা জানি না। যাঁরা সই করাতে এসেছিলেন, তাঁদের চিনিও না। সাহেবের নাম করে বলেছিল, আমি সই করে দিয়েছিলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সই নেওয়া হয়ছিল। উলটোডাঙায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে সই করেছিলাম। বলেছিল, সাহেব পাঠিয়েছে, সই করে দিতে হবে।’’ রামস্বরূপ শর্মা জানান, ‘‘আমি ইডি’কে এদিন আমার জানা সব তথ্যই জানিয়ে এসেছি।’’ 
আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নাম করে তাঁর বাহিনী সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। আর পরবর্তীতে এই বাড়ির পরিচারকই বেমালুম একটি সংস্থার ডিরেক্টর হয়ে গিয়েছিলেন। আদৌ তিনি জানতেনই না যে, কোম্পানির ডিরেক্টর তিনি। আসলে ভুয়ো সংস্থা। যশোর রোডে ভগবতী কলোনির একটি ঠিকানাতেই তিনটি সংস্থা। তিনটি সংস্থাই ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে একই তারিখে তৈরি হয়েছিল। তিনটি সংস্থাতেই ডিরেক্টর বানিয়ে দেওয়া হয় মন্ত্রীর বাড়ির এই পরিচারককে। আসলে এই ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমেই রেশন দুর্নীতির টাকা পাচার করা হয়েছে অন্যত্র। ইডি’র দাবি, সারদা থেকে কয়লা, গোরু হয়ে নিয়োগ দুর্নীতি এবং সর্বশেষ রেশন দুর্নীতিতে একই মডেল। ভুয়ো ও শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে টাকা পাচার।
নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিও একাধিক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ও দলীয় কর্মীর নামে ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে টাকা অন্যত্র পাচার করেছিলেন, বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রায় ২০০টির বেশি ভুয়ো সংস্থা ছিল তাঁর। সংস্থার যাঁরা ডিরেক্টর, তাঁরা নিজেরাই জানতেন যে, তাঁদের নামে কোম্পানি খোলা হয়েছে। 
এবার রেশন দুর্নীতিতেও একই মডেল দেখা গেল। বাড়ির পরিচারকের নামে ২০২১ সালে তিনটি ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে বিপুল টাকা তার মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়েছিলেন ধৃত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ঠিক একই ভাবে দেখা গিয়েছে, বাকিবুর রহমানের নামেও রয়েছে ১৬টি সংস্থা। সবক’টি সংস্থার ডিরেক্টর বাকিবুর রহমান। তার মধ্যে ১২টি সংস্থাই তৃণমূল সরকারে আসার পরে, ২০১১’র সালে মে মাসের পরে তৈরি হয়েছে! এর মধ্যেই ছয়টি শিখণ্ডী বা শেল কোম্পানিতে খাদ্যসাথী প্রকল্পে রেশনের মাধ্যমে আটা বণ্টন দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে। সেই দুর্নীতির ৫০ কোটি ৫৫ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা ঢুকেছে বাকিবুরের এরকম ৬টি ভুয়ো সংস্থায়।

 

Comments :0

Login to leave a comment