মোহভঙ্গ হয়েছে বিভূতিভূষণ ভুইঞার।
হাঁটুর ওপর ময়লা ধুতি, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি। সামনেই মুড়িগঙ্গা। বৃদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন বাঁধের ওপরে। বাঁধ বলতে অবশিষ্ট ভাঙা ইটের টুকরো আর উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাঙড়। নদীর জলের স্রোত এসে যতই ধাক্কা মারছে, ততই ধসে যাচ্ছে বাঁধ। এই ঠুনকো বাঁধ বানানোর নাম করেই বিঘা বিঘা জমি নেওয়া হয়েছে বিভূতিভূষণ, মায়া হালদার, ইফতিকার আলমদের কাছ থেকে। ক্ষতিপূরণের কোনও টাকাই মেলেনি। অথচ সরকারি খাতায় ক্ষতিপূরণ প্রাপক হিসাবে নাম রয়েছে তাঁদের। তাহলে টাকা গেল কাদের পকেটে? টাকা চেয়ে মারও খেয়েছিলেন বুধাখালির বৃদ্ধ বিভূতিভূষণ।
সেখানে কারা মারলো কৃষিজীবী পরিবারগুলির টাকা?
উত্তর এলো- ‘ওই যে দলটা করতাম, তৃণমূল। ওদের ছেলেরাই তো মারলো। কাগজপত্র নিয়ে গেলাম বিধায়কের কাছে। বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরার দলবল বললে, আরে রেখে দাও তোমার কাগজপত্র।’ বৃদ্ধের পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীতা হালদার, সন্তোষ পাত্ররা বললেন, ঘাসফুলের কথামতো চলছে প্রশাসন। অভিযোগ জানাতে গেলে তারা বলছে, ‘আমরা আমাদের কাজ করব, তোমরা বলার কেউ নও।’
এলাকাবাসীর প্রশ্ন, আমরা যদি বলার কেউ নই, তাহলে এই তৃণমূল দল ভোট চাইছে কোনমুখে? এই অবজ্ঞার জবাব আমরা দেবই দেব।
সুন্দরবনের নদী, খাঁড়ি, খালে ছড়িয়ে আছে চুরি। নদীর ড্রেজিংয়ের জন্য ১২০ কোটি টাকার বরাদ্দের হিসাব নেই। বাঁধ মেরামতির বরাদ্দ হয়েছে, খরচের হিসাব নেই। একদিকে নদীর পাড়ের বালি তুলে পাচার হয়ে যাচ্ছে, আর পকেট উপচে পড়ছে শাসকের। আর এক দিকে মাটির বাড়ি আঁকড়ে ধরে কোনোমতে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আর এক দল গরিব, নিরন্ন মানুষ। বান এলেই ভেসে যাবে শত শত পরিবার। মুড়িগঙ্গা নদীর ধারে এইসব অভিযোগ হাজারো গ্রামবাসীর। সিপিআই(এম) প্রার্থীদের প্রচারে এখন উঠে আসছে এসব কথাই। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের উত্তরসূরিরা লাল ঝান্ডাধারীদের কাছেই জানাচ্ছেন সেইসব অভিযোগ।
বুধাখালি, ইশ্বরীপুর, নাদাভাঙ্গা- ভাঙন গ্রাস করেছে বাড়িঘর। খরচ দেখানো হয়েছে কিন্তু ব্রিজ কংক্রিট হয়নি। কাকদ্বীপ এলাকার প্রায় ৫০ কিমি নদীবাঁধে কোনও মাটি পড়লো না। উপরন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে মাটি কাটার কাজ। পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে ধ্বংস করা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ, বলছেন গ্রামবাসীরা। নড়বড়ে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে নদীগর্ভে ভিটেমাটি হারানোরা বলছিলেন, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নয়, নদী বাঁধ দাও- আমাদের বাঁচাও।’ একথা শাসক দলকে বা প্রশাসনকে বলেননি? প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন, ‘প্রশাসন থেকে শাসক দল সবাই বলছে, আমরা আমাদের কাজ করব, তোমরা কেউ বলার নও।’
গ্রামে গ্রামে এবার পালটা জোট বাঁধছেন মানুষ। ভিত ক্রমশ টলমলে হচ্ছে শাসক দল তৃণমূলের। একথা অনুভব করতে পারছেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই(এম) প্রার্থী মৈত্রী ভুইঞা, নন্দদুলাল দাস, শিখা দাসরা। তেভাগার মাটি বুধাখালি— কাকদ্বীপ মহকুমার লড়াইয়ের সোনালি রেখা।
জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিআই(এম) প্রার্থীদের প্রচারে উঠে আসছে আরও অসংখ্য অভিযোগ। এলাকায় এলাকায় জল নিকাশি ব্যবস্থা থেকে পানীয় জল— বহুদিনের সমস্যা মোকাবিলার কোনও উদ্যোগ নেই তৃণমূল সরকারের। সংস্কার নেই ঘাটগুলির, প্রতিদিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন গ্রামের মানুষ। কাকদ্বীপের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জলসেচ প্রায় নেই। অথচ ধান ক্রয় বিক্রয়ই প্রধান উপার্জনের পথ কাকদ্বীপের মানুষের। সিপিআই(এম) নেতৃত্বের বক্তব্য, মৎস্যজীবী এলাকায় রিলিফ- কাম- সেভিংস পলিসি চালু করার জন্য লড়াই চলছে। জব কার্ড যাতে প্রকৃত কার্ড হোল্ডারদের হাতেই থাকে, আমাদের লড়াই তার জন্যেও। সে সবের বালাই রাখেনি তৃণমূল।
কাকদ্বীপ এলাকায় অন্যতম প্রধান জীবিকা মাছ ধরা। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান কার্যকর না হওয়ায় জলের স্রোত কমে গেছে বর্তমানে। ওদিকে তাজপুরে আদানি বন্দরের জন্য জমি নেওয়ায় পোর্ট ট্রাস্ট যে ড্রেজিং করতো-তা হচ্ছে না। ফলে মৎস্যজীবীদের মাছের সন্ধানে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। সেখানে বহু ক্ষেত্রেই বিপদে পড়ছেন তাঁরা, মিলছে না ভালো মাছও। শুধু তাই নয়, সিপিআই(এম) নেতৃত্বের বক্তব্য, লাভ তেমন না হওয়ায় ট্রলার মালিক কম মজুরি দিচ্ছেন মৎসজীবীদের। এভাবেই রুজি রোজগারের তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পড়ছেন অসংখ্য মৎস্যজীবী। সরকারিভাবে বলা হয়েছে ৭০ এমএম রাখতে হবে জালের ফাঁকের মাপ। কিন্তু এই মাপের ফাঁকে ধরা পড়ছে ছোটো মাছও যা আবার আইন বিরুদ্ধ। ফলে চূড়ান্ত সমস্যার সন্মুখীন মৎস্যজীবীরা। দুর্নীতি হয়েছে লাইফ জ্যাকেট, ব্লিচিং নিয়েও।
একদিকে যখন এই অবস্থা তখন অন্যদিকে আবাস যোজনার কাটমানি থেকে নির্মল গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম করে শৌচালয় বানানোর জন্য কাগজে সই করিয়ে নেওয়ার কাজে নেমেছে তৃণমূল। একইভাবে স্টেট ফিনান্সের টাকায় কমিউনিটি টয়লেটের নামে টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোস্টাল এরিয়াতে তার একটিও দিনের আলো দেখেনি বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। অথচ সম্পত্তি বেড়েছে তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধান থেকে সদস্যদের।
ভোট যত এগিয়ে আসছে, গ্রামে গ্রামে বাড়ছে এসবেরই আলোচনা। প্রমাদ গুনছে শাসক।
Comments :0