মানব লাহিড়ী
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। কুয়ারি পাস ট্রেক করার সময় কথায় কথায় বেদাতি দি’র কাছে শুনে রূদ্রপ্রয়াগের কাছে একটা নাকি জায়গা আছে। অল্প ট্রেক করে সেখান থকে নাকি দারুণ হিমালয় দেখা যায়। পরে মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল জায়গাটার নাম। কয়েক বছর আগে ফেসবুকে সুমিত দা’র (চ্যাটার্জি) হঠাৎ একটা ছবি দেখে দেখে চমকে উঠি। আরে এর কথাই তো তখন শুনেছিলাম। নাম কার্তিকস্বামী। মন্দিরের সামনে সারি সারি ঘণ্টা, আর পিছনে সুউচ্চ প্রাচীরের মত ঘিরে রয়েছে গাড়োয়ালের তুষারধবল সব শৃঙ্গ। তখন থেকেই মনটা উচাটন হয়েছিল কবে যাওয়া যায় কার্তিকস্বামী। খোঁজখবর করে দু বছর আগেই তৈরি হয়েছিলাম এই জায়গায় যাওয়ার জন্য। নানা কারণে সেবার আর যাওয়া হয়নি। এ বছরের এপ্রিল- মে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। সুমিতদার থেকেই জানতে পারলাম এখন আর কণকচৌরি থেকে রাত থাকতে ট্রেক করে কার্তিকস্বামী যেতে হয় না। মন্দিরের এক কিমি নিচে মন্দির কমিটির একটা গেস্টহাউস তৈরি হয়েছে সেখানে থেকেই পরদিন ভোরে যাওয়া যায় সূর্যোদয় দেখতে।
সব শুলুকসন্ধান সেরে এবছর পুজো মিটলেই পাড়ি দিলাম কার্তিকস্বামীর উদ্দেশ্যে। দলে পুরুষ মহিলা মিলে মোট দশজন। হরিদ্বার থেকে সাত সকালেই রওনা দিলাম কণকচৌরির দিকে। পথে দেখে নিলাম রুদ্রপ্রয়াগের কাছেই কোটেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের নিচ দিয়ে দুই উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে অলোকানন্দা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কণকচৌরির দূরত্ব মাত্র ৩৮ কিমি। ঝাউ বনের মধ্যেদিয়ে রাস্তা চলেছে এঁকেবেঁকে। গাড়ি ঘোড়ার ব্যস্ততা নেই। নেই মানুষের ভিড়। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম কণকচৌরি। ছোট্ট একটা গ্রাম। কয়েকটা হোম-স্টে, কিছু দোকানপাট। অনেকেই এখানে থেকে গভীর রাতে ট্রেক করে সূর্যোদয়ের আগে পৌঁছে যান কার্তিকস্বামী। এখনও তেমন জনপ্রিয় হয়নি এই পর্যটন কেন্দ্র। গাড়োয়ালের অনেকেই এই গ্রামের নাম শোনেনি।
গাড়ি থামতেই এগিয়ে এলেন দেবী সিং নেগি। যার সাথে যোগাযোগ করে কার্তিকস্বামী যাওয়া প্রোগ্রাম করা সেই জগদীশ সিং নেগির সাথে কথা বলে নিয়েছিলাম, তিনি পাঠিয়েছেন দেবীজিকে। তিনি আমাদের মালপত্তর নিয়ে যাবেন। যদিও ব্যাগ পত্তর কণকচৌরিতে রেখে সামান্য গরম জামাকাপড় নিয়ে ওঠা যায় কার্তিকস্বামী। পোর্টারের প্রয়োজন হয় না।
গ্রামের মাঝেই ছোট্ট গেট দিয়ে কার্তিকস্বামী মন্দির যাওয়ার পথ। সেই পথ ধরেই এঁকেবেঁকে উঠে গেছে রাস্তা। দু’চারটে বাড়িঘর পেরোতেই শুরু হলো জঙ্গল। নানা ধরনের রডোডেনড্রন। যদিও এখন ফুল ফোটার সময় নয়। বেশ ঘন জঙ্গল। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দুপুরের রোদ। আর ডানদিকে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাছে তাদের, যাদের দেখার জন্যই এখানে আসা। চড়াই আছে, তবে মারাত্মক কিছু নয়। মাত্রতো দু কিমি। কিছু রাস্তা পাথরে বাঁধানো থাকলেও বেশিটাই মাটির পথ। তাই উঠতে বেশ মজাই লাগছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসে। দূরে উঁচুতে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের চূড়া।
দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিলাম মন্দিরের উদ্দশ্যে। এবার আর জঙ্গল নেই। শুধুই চড়াই। কোথাও পাথর বাঁধানো কোথাও এমনি। শেষে শুধুই সিঁড়ি। গোনা হয়নি প্রায় একশোর কাছাকাছি হবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একেবারে ক্রোঞ্চ পর্বতের মাথায়। উঠেই পথ চলার সব কষ্ট শেষ। মন্দিরের পিছনে রেলিং দিয়ে ঘেরা বাঁধানো বিরাট চাতাল। সেখান থেকে দেখা মিলছে একের পর এক গাড়োয়াল আর কুমায়ুনের নাম করা সব শৃঙ্গ। আমরা সকলেই বাকরূদ্ধ। দু’হাত সর্বোচ্চ যতটা প্রসারিত করা যায় তা প্রসারিত করেও শৃঙ্গগুলো দেখা শেষ হচ্ছে না। তখন কেউ আমরা টাইটানিকের জ্যাক কেউবা রোজ। আক্ষরিক অর্থেই ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ। নানা লেখা ব্লক সবেতেই কার্তিকস্বামীর সূর্যোদয়ের কথা শুনেছি। সূর্যাস্তেও সে যে কি অপরূপ দৃশ্য হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। গোধূলি আলোয় তখন মন্দির সেজে উঠেছে। বন্দরপুঞ্ছ পর্বতের পিছন দিকে সূর্য যখন অস্তরাগে তখন তার লাল ছটায় রাঙিয়ে উঠেছে ডান দিকের ত্রিশূল, দ্রোনাগিরি সহ কুমায়ুনের সব পর্বত। নয়নাভিরাম সে দৃশ্য।
এক সঙ্গে এত পর্বত শৃঙ্গ এর আগে কোথাও দেখিনি। বাঁদিক থেকে একে একে বন্দরপুঞ্ছ, ভাগীরথী ১,২,৩, যোগীন, থলাইসাগর, ভৃগুপন্থ, কেদারনাথ, কেদারডোম, সুমেরু, সতোপন্থ, মান্দানি, জানুকূট, খরচাকুন্ড, চৌখাম্বা, বালাকুন্, নীলকন্ঠ থেকে শুরু করে ত্রিশূল, দ্রোনাগিরি, নন্দাখাত, নন্দাদেবী সহ আরো কত কত শৃঙ্গ। নিচে কেদার ভ্যালি, সারি গ্রাম, চন্দ্রশিলাও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। সকালে গেলে ডান দিকের পাহাড়গুলি ভাল করে দেখা যায় না। কারণ ওই দিক থেকে সূর্য ওঠে। আমরা ভাগ্যবান সুনীল আকাশে সকাল ও বিকেলে সবকটা পিক সুন্দর ভাবে দেখতে পেলাম।
পরদিন সূর্য ওঠার আগেই ফের মন্দির চত্বরে। বেশ ঠান্ডা। খালি পায়ে পাথরের মেজেয় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। পূবদিকে সামান্য মেঘ থাকায় আগের দিন বিকেলের মত পাহাড়গুলো তত রাঙা হলো না। কিন্তু একটু পরেই সূর্যের আলোয় সব শৃঙ্গগুলো হয়ে উঠল আরো জীবন্ত, প্রাণবন্ত। ঠান্ডার কষ্ট উপেক্ষা করেই চলল ফটোসেশন। ততক্ষণে মন্দিরের দরজা খুলে গেছে।
উত্তর ভারতে কার্তিকের একটই মন্দির এই কার্তিকস্বামী। এই মন্দির নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে তার মধ্যে জনপ্রিয় হল। জ্যেষ্ঠ পুত্র কার্তিক নাকি কনিষ্ঠপুত্র গণেশ— কে বেশি তার বাবা-মা’কে ভালোবাসেন তা পরীক্ষা করার জন্য একবার পিতা মহাদেব এবং মাতা পার্বতী ছোট্ট একটি পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁরা সন্তানদের জানিয়েছিলেন, যে পুত্র ব্রহ্মাণ্ড প্রদক্ষিণ করে আগে তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারবে, সেই পুত্রই তাঁদের বেশি ভালোবাসে বলে প্রমাণিত হবে। শোনা মাত্রা কার্তিক তাঁর ময়ূরের পিঠে চড়ে ব্রহ্মাণ্ড প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়েন। অন্যদিকে গণেশ তাঁর পিতা মাতাকে প্রদক্ষিণ করে জোড় হস্তে বলেন, তাঁর কাছে পিতা-মাতাই ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ! একথা শুনে পিতা মহাদেব ও মাতা পার্বতী অত্যন্ত প্রসন্ন হন। কিছু সময়ের মধ্যে কার্তিকও ব্রহ্মাণ্ড প্রদক্ষিণ করে এসে ফিরে আসেন ও দেখেন পিতা-মাতার ক্রোড় অধিকার করে বসে আছেন গণেশ। এরপর গণেশের বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে তিনি পিতা মহাদেব ও মাতা পার্বতীর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর মনে হয়, পিতা-মাতা কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতি বেশিই স্নেহশীল। তিনি রাগের তেজ শান্ত করতে ক্রোঞ্চ পর্বতের চূড়ায় বসে কঠোর তপস্যা শুরু করেন দেহের মাংস ও হাড় পরিত্যাগ করেন ও পিতামাতার প্রতি তাঁর ভক্তির পরিচয় দেন। ওই স্থানেই পরবর্তীকালে তৈরি হয় মন্দির।
গল্প কথা গল্পে থাক। পর্যটকরা উপভোগ করেন হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য। পর্যটকরা আসেন হিমালয়ের তুষারধবল শৃঙ্গরাজির টানেই। সেই অর্থে কার্তিকস্বামী মন্দিরের পিছনের চাতাল যেন বিরাট এক ব্যালকনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।
এবার নামার পালা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে এলাম গেস্ট হাউসে। স্যাক গুছিয়ে যাত্রা শুরু। এবার আর দেবী সিং নয়। স্যাকগুলি বইছে তার নাতি। সেই জানালো কণকচৌরিতে তাদের যথেষ্ট জমিজমা আছে। পুজোর সাগ্রমীর দোকানগুলোও তাদের। অল্প সময়েই নেমে এলাম কণকচৌরি। বাঁ পাশে সবসময় সাথী চৌখাম্বা, কেদারশৃঙ্গ।
আবার আসতে হবে কার্তিকস্বামী। মার্চের শেষে এপ্রিলের শুরুতে লাল গুরাসে সেজে ওঠে এই জঙ্গল। তখন এর মায়াবী রূপ। তবে আস্তে আস্তে পরিচিতি পাচ্ছে এই কার্তিকস্বামী। অচিরেই হয়তো তৈরি হয়ে যাবে আরো অনেক হোটেল, ধর্মশালা গাড়োয়ালের অতি পরিচিত অন্যান্য ধর্মস্থানের মতই। কোলাহলে নষ্ট হবে এর প্রাকৃতিক মাধুর্য। তার আগেই অন্তত আর একবার দেখে নিতে হবে কার্তিকস্বামী।
অতিরিক্ত: মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসে থাকা, খাওয়া, গাইড ও পোর্টারের জন্য (যদিও এই রাস্তায় গাইডের প্রয়োজন হয় না) যোগাযোগ করা যেতে পারে জগদীশ সিং নেগির সাথে। মোবাইল নম্বর- 9548425668/9410996283। বা কার্তিকস্বামী মন্দিরের পুরোহিত 9639306282 এই নম্বরে।
Comments :0