অন্যকথা | মুক্তধারা
কান্ডারী বলো, ডুবেছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
সম্প্রীতি রক্ষার শহীদ আমির হোসেন চৌধুরী
কৃশানু ভট্টাচার্য্য
সেদিনটা ছিল ১৯৬৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি। রোজকার মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন ৫৪ বছর বয়সী মানুষটি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হবার পর থেকে যার ঠিকানা সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহর ঢাকা। কদিন আগেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি রক্তাক্ত করেছিল শহরটাকে। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু মানুষের উপরে চলেছিল অবর্ণনীয় অত্যাচার। সেই অত্যাচারকে রুখে দিতে কার্যত একা এবং কয়েকজন। এই কয়েকজনের অন্যতম ছিলেন তিনি। আর সে কারণেই হয়ে উঠেছিলেন ওদের চোখে শত্রু। ওরা কারা?
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে পাকাপোক্তভাবে পরিচালনা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সম্প্রদায় সম্প্রদায়ে বিচ্ছিন্নতা তৈরি কৌশল গ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। সেই কৌশল এক সময় নিয়েছিল এক চক্রান্তের চেহারা। এর পরিণামে পৃথক দেশের দাবি , সেই দাবিকে সামনে রেখে রক্তপাত, হানাহানি, সম্প্রদায় সম্প্রদায়ের লড়াই হয়ে উঠেছিল এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত ঘটনা।
এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে লড়াই করেছেন বহু মানুষ । প্রাণও দিয়েছেন। কিন্তু দেশভাগ ঠেকানো যায়নি। এমনকি দেশভাগের পরেও বন্ধ হয়নি এই হানাহানির ঘটনা।
১৯৪৭ সাল। সদ্য স্বাধীন দেশে সেপ্টেম্বর মাসে দুই সম্প্রদায়ের হানাহানি ঢাকাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন শচীন মিত্র। শচীন মিত্রের মৃত্যুর পর শহর জুড়ে যে উত্তেজনা তা প্রশমন পার্ক স্ট্রিট ও সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে একটি তীব্র চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুশীল দাশগুপ্ত ও স্মৃতীশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। উন্মত্ত জনতার ছুড়িকা খাতে রাস্তাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন স্মৃতীশচন্দ্র। দিনটা ছিল ১৯৪৭ এর ১ লা সেপ্টেম্বর। এগারো দিনের মাথায় হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন সুশীল দাশগুপ্ত।
তবুও বারে বারে মানুষে মানুষে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একদল মানুষ রাস্তায় নেমেছে। এপারে, ওপারেও। আমির হোসেন চৌধুরী তাদেরই একজন। জন্মসূত্রে তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বোন হুমায়ুরার পুত্র। মা ছিলেন লেডি ব্র্যাবন কলেজে ছাত্রী নিবাসের প্রথম অধ্যক্ষ। আমির হোসেন পড়তেন কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজে। বিএ পাশ করে সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী হিসেবে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এর জন্য একাধিকবার কারাবরণও করেছিলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতার খিদিরপুর এলাকার ব্যবসায়ী জানে আলমের কন্যা গুলশান আর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। সে সময় তারা সপরিবারে থাকতেন পার্ক সার্কাস অঞ্চলে।
দেশ স্বাধীন হলো। দেশভাগ হলো। কলকাতা ছাড়লেন আমির হোসেন চৌধুরী। গেলেন ঢাকায়। অধ্যাপক কুদরতি খোদার পরামর্শে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন ওষুধ এবং কালি তৈরীর ব্যবসা। ঢাকাতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে নিয়ে চর্চা। গড়ে উঠল নজরুল ফোরাম। উদ্দেশ্য সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। নজরুল কে নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছিলেন। ১৯৬২ তে মারা গেলেন মা।
৬৪ সালে হল তীব্র দাঙ্গা। আমির হোসেন চৌধুরী থাকতেন পুরনো ঢাকার একটি অঞ্চলে। সেখানে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরোধিতা করে হিন্দুদের বাঁচাবার জন্য তিনি রাস্তায় নামলেন। আবার অসম লড়াই। অন্ধ মানুষের সঙ্গে সচেতন মানুষের। সে লড়াইয়ে তিনি জিতলেন কিন্তু মুসলিম লীগের নেতা নুরুল আমিন সহ বহু দুষ্পৃতির চোখে হয়ে উঠলেন এক নম্বর শত্রু।
দাঙ্গা মিটে যাবার পরে একদিন বাজার যাবার পথে মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিন এর নেতৃত্বে একটি মিছিল থাকে তাকে আক্রমণ করা হলো। এখন যেখানে ঢাকার বঙ্গভবন সেইখানে রাস্তার উপর তাপে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা হলো। ফ্রি এবং বন্ধুরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়। আমির হোসেন চৌধুরী পূর্ব বাংলায় সম্প্রীতি রক্ষার অন্যতম শহীদ।
দাঙ্গা থামে নি। দাঙ্গা থামে না। দাঙ্গা থামাতে হয়। দাঙ্গা রুখে দিতে হয়। আমির হোসেন চৌধুরীরা আমাদের কাছে এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন।
অঙ্কন : রাহুল দত্ত
দশম শ্রেণী
কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ খড়দহ উত্তর ২৪ পরগনা
Comments :0