বই
জ্যোতি বসু কেন জ্যোতি বসু
কৃশানু ভট্টাচার্য্য
মুক্তধারা
কালের নিয়মে কখনো কখনো এমন কিছু গ্রন্থ রচিত হয় যা বহুকাল ধরে তথ্যের ভান্ডার হিসেবে আমাদের সামনে পরিচিত হয়। সেই গ্রন্থ গুলি হয়ে ওঠে দশকের পর দশক ধরে গবেষকদের অবলম্বন। কারণ সময়কে তথ্যনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরার কাজে এই বইগুলিকে প্রথম সারিতেই রাখতে হয়। এমনকি যে ব্যক্তি লেখক এর বা লেখক এর মতাদর্শের বিরোধী তাদের কাছেও সেই সময়ের বিশ্লেষণে ওই বইগুলি হয়ে ওঠে আকর গ্রন্থ। অবিভক্ত বাংলা এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই ধরনের দুটি গ্রন্থ যা যুগের পর যুগ ধরে পাঠকদের সমৃদ্ধ করেছে তার একটি রচয়িতা আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় মুজফফর আহমেদ, দ্বিতীয়টি রচয়িতা সরোজ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু দুটি বইয়ের ক্ষেত্রে একটা সময় সীমায় এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়। তারপরে সামগ্রিকভাবে সাম্যবাদী আন্দোলনের বিকাশের ধারাকে তথ্যনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরার প্রয়াস সে অর্থে খুব সক্রিয় নয়। এক্ষেত্রে অমলেন্দু সেনগুপ্তর' উত্তাল চল্লিশ ::অসমাপ্ত বিপ্লব' কিম্বা জোয়ার ভাটায় ষাট সত্তরের কথা মাথায় রেখেই এই মন্তব্য।
প্রদোষ কুমার বাগচী দীর্ঘদিন ধরে জ্যোতি বসুর জীবনের দিনপঞ্জি নন্দন পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। জ্যোতি বসুর জীবনের নানা পর্ব সম্পর্কে তার কাছে প্রচুর তথ্য সংকলিত রয়েছে। তারই প্রাথমিক অংশ বিভিন্ন কালসীমার মধ্যে বিন্যস্ত করে ছয় খন্ডে একটি গ্রন্থের তিনি পরিকল্পনা করেছেন। তার প্রথম খন্ডটি গত জুলাই মাসে পাঠকদের সামনে এসেছে। যদিও বইটি জ্যোতি বসুর জীবনী হিসেবে রচিত, তবুও এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে জ্যোতি বসুর কথা বলতে গিয়ে তিনি যে সময়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে জ্যোতি বসু এদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই সময়কেই তথ্যনিষ্ঠ ভাবে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র তথ্যসূত্র কে সামনে রাখা নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার প্রমাণ হিসেবে সমসাময়িক দলিল এবং সংবাদপত্র গুলির প্রতিবেদনের ছবি বইটির মধ্যে রয়েছে। তথ্যের প্রামাণ্যতার সঙ্গে সঙ্গে এর মধ্যে দিয়ে অতীতের দিনগুলো চলমান ছবির মতপাঠকদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই কারণে, এই বইটি একাধারে ইতিহাসের দলিল অন্যদিকে এই বইটির মধ্যে দিয়ে একটা সময়কে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে যা সাধারণ পাঠকের কাছে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয়।
লেখক বইটির প্রথম খন্ডে যে অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে রয়েছে ১৯১৪ থেকে ১৯৩৯ এর ঘটনাবহুল পর্ব। শৈশব থেকে বিলেতে শিক্ষা জীবনের নানা অজানা কথা তার মধ্যে দিয়ে পাঠকের কাছে ফুটে উঠবে।
এরপরের স্বাধীনতা পূর্ব সময়কে লেখক তিনটি অধ্যায়ের বিন্যস্ত করেছেন। একটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল অর্থাৎ ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫। দ্বিতীয়টি ১৯৪৬ এর সংকটময় দিনগুলির দিনলিপি এবং অবশেষে তৃতীয় পর্বে স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের দিনগুলি ।তৃতীয় পর্বটির তিনি নামকরণ করেছেন 'বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারেনি কমিউনিস্টরা'। নামকরণেই স্পষ্ট দেশভাগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা ধরনের অপপ্রচার এবং কুৎসার জবাব মিলবে এই অধ্যায়। এ তো লেখক বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখের মধ্যে দিয়ে তার বিশ্লেষণটি এবং এই সময় জ্যোতি বসুর ভূমিকাটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাতে বহু প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে।
এর পরবর্তী স্তরে স্বাধীন ভারতবর্ষে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ যার মধ্যে অন্যতম কমিউনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধ হওয়া এবং প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্টদের অবস্থান আলোচিত হয়েছে। এই পর্বটিকে ছয়টি অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বইটির সঙ্গে নির্দিষ্ট হয়েছে ১৯১৪ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত জ্যোতি বসুর জীবনের দিনপঞ্জি যা অবশ্যই সেই সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমাদের সামনে তুলে ধরে। এ ধরনের বইতে নির্ঘণ্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা যত্নের সঙ্গে সংকলিত এবং গবেষকদের কাছে খুব সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠবে। সাধারণত নির্ঘণ্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নাম প্রাধান্য পায়। এই বইতে ব্যক্তি নামের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন স্থান এবং সংগঠনের উল্লেখ্য রয়েছে যা অবশ্যই একটি বাড়তি পাওনা। বইটিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রচনা করেছেন বর্ষীয়ান নেতৃত্ব বিমান বসু যা নিঃসন্দেহে এখানে বইটি পড়বার আগেই পাঠকদের বিষয়টি প্রতি উৎসাহিত করবে। একটি আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন মনীষ দেব। সমুদ্রিত এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
জ্যোতি বসু কেন জ্যোতি বসু
প্রথম খন্ড (১৯১৪- ১৯৫৩)
প্রদোষ কুমার বাগচী
একুশ শতক
কলকাতা ৭৩
মূল্য ৬০০ টাকা
Comments :0