মেরুকরণের রাজনীতি ধাক্কা খেল, একই সঙ্গেই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির আস্ফালনও গেল চুপসে। বসে গেল ‘ডবল ইঞ্জিন’র একটা চাকাও। মানুষের রুটি-রুজির চাহিদার কাছে হার মানলো ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক জিগিরের কৌশল। মোদীর ‘জয় বজরঙবলি’ ধ্বনি তুলে ভোট দেওয়ার উসকানিও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন সিংহভাগ কর্নাটকবাসী। পূর্বাভাস ছিলই হারের, তবে কর্নাটকে কংগ্রেসের হাতে এভাবে পর্যদুস্ত হতে হবে, তা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দোসররা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমারের কথাই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। ১৪১ না হলেও কংগ্রেস পেল ১৩৭ আসন, ৩৪ বছরের মধ্যে কর্নাটকে জয়ী যে কোনও দলের ক্ষেত্রে সর্বাধিক। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, কর্নাটকে হারের ফলে দক্ষিণ ভারত থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল বিজেপি।
ভোট শতাংশের হিসাবে কংগ্রেস গতবারের থেকে অনেকটা বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন আদায় করেছে। বিজেপি’র ভোট প্রায় গতবারের মতোই (৩৬%) থাকলেও লক্ষণীয়ভাবে কমেছে জনতা দল (এস)’র ভোট এবং আসনসংখ্যা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার দলের আসন ৩৭ থেকে কমে হয়েছে ১৭, শতাংশের হিসাবে হারিয়েছে ৫ শতাংশ সমর্থন। বিজেপি’র আসন ১০৪ থেকে নেমে গিয়েছে ৬৫-তে। তিনজন নির্দল জয়ী হয়েছেন। লিঙ্গায়েতদের মধ্যে এবার ভালো ফল করেছে কংগ্রেস। ভোক্কালিগা গোষ্ঠীর ভোট ঐতিহ্যবাহী হিসাবে জনতা দল (এস)’র পক্ষে থাকলেও এবার তাতে ভাগ বসিয়েছে কংগ্রেস। এমনকি জনতা দল (এস)’র মুসলিমদের মধ্যে সমর্থনও সরে গিয়ে পড়েছে কংগ্রেসের ঝুলিতে। বিজেপি একমাত্র উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে নিজেদের সমর্থন অটুট রাখতে পেরেছে। ভালো ফল করেছে বেঙ্গালুরু শহরের অভিজাত এলাকার আসনগুলিতে।
বিপুল ভোটে জিতেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শিবকুমার। তাঁর জয়ের ব্যবধান ১লক্ষ ২২ হাজার। জিতেছেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের সিদ্দারামাইয়া, জনতা দল (এস)’র এইচ ডি কুমারাস্বামী, বিজেপি’র বি এস ইয়েদুরাপ্পা। জিতেছেন সদ্য বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া লক্ষ্মণ সেবাদিও। তবে আরেক বিজেপি-ত্যাগী রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার আশ্চর্যজনকভাবে ছ’বারের জেতা আসনে এবার পরাস্ত হয়েছেন। হেরেছেন হিজাবের ধুয়ো তোলা বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশও।
কংগ্রেস এবার ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের চেহারা তুলে ধরে প্রচারে ‘সুশাসন’ এবং ‘দুর্নীতিমুক্ত’ কর্নাটক গড়ে তোলার বার্তা পৌঁছে দেয় ভোটারদের কাছে। পাশাপাশি মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পাঁচ ‘গ্যারান্টি’র কথা ঘোষণা করে। জানিয়ে দেয় কংগ্রেস ভোটে জিতলে বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে ১০ কেজি করে চাল, পরিবারের কর্ত্রীকে মাসে ২ হাজার টাকা করে সহায়তা, ১৮-২৫ বছর বয়সি যুবক-যুবতীকে স্নাতক হলে মাসে ৩ হাজার এবং ডিপ্লোমাধারীদের ১৫০০ টাকা ভাতা এবং মহিলাদের সরকারি বাসে বিনামূল্যে যাতায়াতের সুযোগ করে দেবে। শনিবার বিপুল জয়ের পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সরকার গঠনের পর মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই ওই পাঁচ গ্যারান্টি রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং লাগামহীন দুর্নীতির পালটা হিসাবে কংগ্রেসের রুটি-রুজির প্রচার যে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন কর্নাটকের মানুষ, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আসনসংখ্যার দিকে তাকালেই। কংগ্রেসের ‘৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার’-এর প্রচারকেও নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বিজেপি-কে হটিয়ে দিয়েছেন মানুষ। প্রাক্ ভোট কিংবা বুথ ফেরত সমীক্ষায় দু-তিনটি ছাড়া বাকিরা কংগ্রেসকে এগিয়ে রাখলেও ত্রিশঙ্কু বিধানসভার আভাস দিয়েছিল। কিন্তু ফল বেরনোর পর দেখা গেল, সেইসব পূর্বাভাস, ইঙ্গিতকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বিপুল জয় হাসিল করে নিলো কংগ্রেস।
মোদী বা তাঁর বাহিনী যে অপ্রতিরোধ্য নয় তা গত ডিসেম্বরে প্রমাণ করেছিলেন হিমাচলবাসী। তবে হিমাচল প্রদেশ থেকেও কর্নাটকে বিজেপি’র পরাজয়ের প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। গত দু’বছরে কর্নাটকে বিজেপি ‘বিভাজনের রাজনীতির’ অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে বারংবার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব বিতর্ক, ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে নিহত টিপু সুলতানের ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে টানাটানি, ওবিসি মুসলিমদের সংরক্ষণ বাতিল, কংগ্রেসের ইশ্তেহারে বজরঙ দল নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতির মতো বিষয়কে হাতিয়ার করে মেরুকরণের চেষ্টা করেছে বিজেপি। এমনকি, ভোটের প্রচারে এসেছে ‘হালাল মাংস’ এবং বিতর্কিত ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রসঙ্গও।
এরই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বা বিজেপি’র তাবড় তাবড় নেতারা দুর্নীতি কিংবা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়ার পালটা হিসাবে মেরুকরণের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে প্রচার চালান কর্নাটকে। প্রচারের শুরুতে এবং শেষে ‘জয় বজরঙবলি’ স্লোগান, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেস সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে ‘ভারত থেকে কর্নাটককে বিচ্ছিন্ন করতে চায় কংগ্রেস’, তাঁকে ‘৯১ বার কংগ্রেস অপমান করেছে’— আস্তিনের নিচ থেকে সব তাসই বের করে এবার খেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এমনকি ভোট প্রচার শেষ হয়ে গেলেও কর্নাটকবাসীকে কংগ্রেসের থেকে সাবধান করতে খোলা চিঠি লিখতেও হাত কাঁপেনি তাঁর। অমিত শাহ তো বলেই দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার অর্থ রাজ্যে দাঙ্গা ফিরিয়ে আনা। অথচ বিজেপি শাসিত মণিপুর যখন জাতি সংঘর্ষের আগুনে পুড়ছে তখন প্রধানমন্ত্রী সেসম্পর্কে কোনও মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন কর্নাটকের প্রচারে। টানা সাতদিনে ১৯টি জনসভা এবং ৬টি রোড শো করেন তিনি। এত কিছুর পরেও বিজেপি’র ঝুলিতে জুটেছে ৬৫টি আসন, গতবারের ১০৪-র থেকে অনেকটাই কম। ফলে সোজা পথে না হলে বিধায়ক ভাঙিয়ে ‘রিসোর্ট রাজনীতি’ করে পিছনের দরজা দিয়ে সরকার গঠনের কৌশলের সুযোগও ঘটল না মোদী-শাহদের।
অন্যদিকে, কংগ্রেস তাদের ইশ্তেহারে সঙ্ঘ পরিবারভুক্ত বজরঙ দল এবং কট্টর মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’র বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছাড়া আগাগোড়া মেরুকরণের ‘ফাঁদ’ এড়িয়ে গিয়েছে প্রচারে। উলটে, ‘জনতা জনার্দন’র কথাই বারে বারে এসেছে প্রচারে এবং তারই ফল হাতেনাতে পেয়েছে দল। রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এবং দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে টানা প্রচারে মানুষের জ্বলন্ত সমস্যা এবং তার সমাধানে প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছেন। শেষে একটি প্রচারে ছিলেন সোনিয়া গান্ধীও। এরই পাশাপাশি রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র প্রভাবও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ২২ দিন রাহুল গান্ধী কর্নাটকের ওপর দিয়ে হেঁটেছেন বিভাজনের বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতের বার্তা দিয়ে।
অনিবার্য এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন। কংগ্রেসের দুই প্রধান মাথা সিদ্দারামাইয়া এবং শিবকুমারের মধ্যে কাউকে বেছে নেবে পরিষদীয় দল। বেঙ্গালুরুতে রবিবারই বসছেন নবনির্বাচিত বিধায়করা। তবে সেক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ডের প্রভাব কাজ করবে কংগ্রেসের রীতি অনুযায়ী। সিদ্দারামাইয়া প্রবীণ নেতা এবং কর্নাটকে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব যথেষ্ঠই। তবে দলেকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে টেনে তুলে এনে ভোটে বিপুল জয়ে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রদেশ সভাপতি শিবকুমারের অবদান অনস্বীকার্য। দেখার এঁদের মধ্যে কে বেঙ্গালুরুর কুর্সিতে বসতে চলেছেন।
Comments :0