Oceanologist Dr. Amalesh Choudhury

অধ্যাপক বিজ্ঞানীর ছুঁয়ে দেখা মাইলফলক

রাজ্য

Oceanologist Dr Amalesh Choudhury ডঃ অমলেশ চৌধুরী

স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়

অতিমারী নিঃস্ব করেছে আমাদেরতেমন পৃথিবীদেশ, রাষ্ট্র হারিয়েছে মেধাপ্রতিভাকোলের সন্তানদের। এ আমাদের সামগ্রিক ক্ষতি, মৃত্যুর কাছে মাথা নত করে হার মান সততই অসহায়তা।

আসলে দেশ মানেই তো পৃথিবীর এক কোলে কাঁটাতার দিয়ে চারপাশ ঘিরে ফেলা একটুকরো জমি নয়,  কোনো বিচ্ছিন্নতা নয়, দেশ মানেই তার পাহাড়নদী, গাছপালাপশুপাখী সবটা নিয়েই আমাদের দেশ ভারতবর্ষএর বুকে পাঁজরে লুকিয়ে থাকা গভীর অরণ্য জলজল অরণ্যের পরিমান কম নয়। এক বুক জলে নেমে সেই অরণ্যকে জাপটে ধরে বাঁচাতে চাওয়াবলা ভালো এই বাঁচানোর ভেতর নিজের বেঁচে থাকার যে অনাবিল আনন্দ আকাঙ্ক্ষা ছুঁয়ে আছে গভীর শিকড়েসেই চিরহরিৎ বটবৃক্ষের মতো পিতৃসম ব্যক্তিত্ব ডঃ অমলেশ চৌধুরী, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম উদ্যোক্তা।

এই অধ্যাপক বিজ্ঞানীর নিঃশব্দ পদচারণা জানে সমুদ্র উপকূলবর্তী বালুচরের প্রতিটি কণাঅন্তরের দুর্দমনীয় তাগিদ আমৃত্যু তাড়িয়ে নিগে বেড়াত যা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ভেতর স্বপ্নের বীজ বপন করে দিয়েছিল। তিনি পেনসিলের একটানে তিন টুকরো করা দেশ নয়গোটা ভারতবর্ষকেই বুঝতেন।

তাঁর জন্ম ১৯৩১ সালের ১১ই জুন মালদার হরিশচন্দ্রপুরেবাবা ছিলেন ক্ষিতীশচন্দ্র চৌধুরীভারতীয় রেলে কর্মরত ছিলেন বহুদিনমা ছিলেন সুষমা দেবী চৌধুরী। ছেলেবেলা কেটেছে কাটিহারেসেখানে ছোটবেলার রসদ গচ্ছিত রেখেছেন অতি সযত্নেযা মনে করতে গিয়ে চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে নামত। বহু পথ পেরিয়ে এসে মাত্র ২১ বছর ৬মাস বয়সে বায়োলজিতে গোল্ড মেডালিস্ট হয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে১৯৬২-তে তাঁর ডক্টরেট অর্জন। এর মাঝে আমতা ও বেলগাছিয়ায় বেঙ্গল ভেটিনারী কলেজে অধ্যাপনা করার সুযোগ পান।

সালটা তখন ১৯৮১। ভারত সরকারের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ওয়েষ্ট বেঙ্গল কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি ভারতবর্ষের সমুদ্রের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো কতটা পরিবেশ গত ভাবে সুরক্ষিত সেই কাজের দায়িত্ব তুলে দেন এই অধ্যাপক বিজ্ঞানীর ওপরযা সময়ের মধ্যেই যথাযথ রিপোর্ট অতি যত্ন সহকারে তুলে দেন সরকারের হাতে। এক সময় মিনিস্ট্রি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ওসেন ডিপার্টমেন্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত পদাধিকারের ভার সামলান যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে। তাঁর জীবনে কাজের পরিধি এতই বিস্তৃত যেখানে তাঁর অধীনে বহু বহু ছাত্রছাত্রী তাদের গবেষণাপত্রে (বিভিন্ন বিভাগে: প্রাণীবিদ্যাপরজীবিবিদ্যাপ্রোটোজোয়াবিদ্যামোহনাএবং সর্বোপরি মোহনা) ডঃ অমলেশ চৌধুরীর অভিভাবকত্ব ছিল চিরস্মরণীয়।

চল্লিশ বছরের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের গবেষণা রেকর্ড গ‍‌ড়ে তুলেছিল যা ছিল সম্পূর্ণ নীরবতিনি আজীবন বিশ্বাস করতেন কাজেস্বল্পমৃদু ভাষী নরম হৃদয়ের মানুষ সমগ্র জীবন দিয়ে প্রাণা করে গেছেনযা সমৃদ্ধ করেছে দেশকে আইসিএআর (ICAR) এবং সিএসআইআর (CSIR) ইউজিসি (UGC)-এর তত্ত্বাবধানে দেহরাদুনে ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউশনে তাঁর গবেষণাএবং ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এবং টেকনোলজিতে সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ রিসার্চ প্রজেক্ট গড়ে তোলেনদিনের পর দিন এক বুক জলে নেমেছাত্রদের নিয়ে সাগরদ্বীপে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারেতাঁর মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সুষমাদেবী চৌধুরানী মেরিন বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট গ‍‌ড়ে তোলেন সন্তানসম স্নেহে। ছিল বুক ভরা স্বপ্ন। আজ সেই সব ছাত্রছাত্রী দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ আসনে অলঙ্কৃত, তারা হাজারো সময়ে ঋণ স্বীকার করেছেন অপরিসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে।

সব্বার কাছে পরিচিত চৌধুরী স্যারউত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক বিজ্ঞানী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কাজ তাঁকে থামতে দেয়নি কখনওতাঁর প্রতিটি গবেষণা সাফল্যের মুখ দেখেছে। যার জন্য সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগ। তিনি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন আন্তর্জাতিক স্তরেওছুটে গেছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। সরাসরি কাজ করার সুযোগ আসে ইন্টার ন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেবার-এর সঙ্গে, যা পরবর্তী ক্ষেত্রে ওয়াল্ড ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ইন্দো-ঢাকা অ্যাসোসিয়েশনে কাজ করার সুযোগ আসে।

বর্তমানে মাঝে মাঝে ইলিশ প্রকল্লর কাজ নিয়ে কিছু কিছু তথ্য সংবাদ শিরোনামে উঠে আসলেও এর বীজ পুঁতেছিলেন ডঃ চৌধুরী, তাঁর গবেষণা দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় চাঁদপুরকে ইলিশ মাছের ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেক আগেই। ভারতের সবকটি নদী মোহনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাজ করেছেন একাধিক বার। তাঁর বহু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যার হিসেব রাখা আছে ভারতীয় তথা বিশ্ব সংস্থার এ‍‌ই সংক্রান্ত গবেষণা গারে। ১৯৫৪-৭৫ সাল পর্যন্ত দীঘা-শঙ্করপুর-সুবর্ণরেখা মোহনা ব্যাপী তাঁর গবেষণার বিষয়, ১৯৫৭-৬৬ পর্যন্ত ভারতের  পূর্ব উপকূল ধরে ও পশ্চিম উপকূলে উড়িষ্যা থেকে কন্যাকুমারী, ও কন্যাকুমারী থেকে কেরালা-গোয়া-কর্ণাটক-বম্বে-গুজরাট উত্তর পশ্চিম শেষ সীমানা বরাবর সমীক্ষার কাজ। এছাড়াও দেশের সীমানা ছেড়ে ১৯৭৪-৮৬ পর্যন্ত ইউরোপে, ১৯৮০-৮২ পর্যন্ত কানাডা ও ১৯৮২-তে ব্রাজিল, ১৯৭৯-তে অস্ট্রেলিয়া, ১৯৮৬-তে পূর্ব আফ্রিকা-কেনিয়ায় কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৭৫-৯৫ পর্যন্ত UNESCO-এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে গবেষণার কাজ চালিয়ে যান, বিশেষ করে বাংলাদেশ, আইল্যানেড্ট, মালয়েশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায়, শ্রীলঙ্কায়, ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকা) ও অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষ করে প্যারিসে (ফ্রান্স)। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তিনি পৌঁছে যান প্রকৃতির গহ্বরে শিকড়ের সন্ধানে।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে সাম্মানিক সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে গেছেন, ১৯৭৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত। এছাড়া ভারত সরকারের একটি অন্যতম প্রধান দপ্তর (অধুনা বিলুপ্ত) প্ল্যানিং কমিশন-এর নির্বাচিত সদস্য হিসেবে পুরো আন্দামান নিকোবর গ্রুপ অফ আইল্যান্ড বেং লাক্ষাদ্বীপ-মিনিস্ট্রি গ্রুপ অফ আইল্যান্ডের তরফ থেকে উন্নয়ন ও পরিকল্পনা মূলক কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন। আই সি এ আর (ICAR), সি এম এফ আর আই ‍‌(CMFRI), সি আই এফ ই (CIFE), সি আই বি এ (CIBA), হয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করেছেন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানী সদস্য হিসেবে। ২০০৩-০৫ সাল পর্যন্ত কলকাতায় সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের অধীনে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (ADB)-এর অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব সামলে গেছেন।

তাঁকে নিজের মুখে একসময় আনন্দের সঙ্গে বলতে শোনা গেছে চারশোর ওপর ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় তাঁর তত্ত্বাবধানে সাফল্য পেয়েছে। যাঁর কাজ সারাজীবনের এক একটা মাইলফলক, তাঁকে সে ছুঁয়ে দেখতেই হবে আগামী প্রজন্ম কতখানি এই বিষয়ের কাজগুলোকে তৈরি অবস্থায় যখন হাতের কাছে পাবে, তখন এই তথ্য দিকপাল বিজ্ঞানী এবং সর্বোপরি সেই মানুষটির কাছে বারবার হাঁটু গেড়ে বসতে হবে ঠিক তার পায়ের কাছে, ধন্য হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বৃত্তটি সম্পূর্ণ পূর্ণতা পাবে ঠিক তখনই। যা রেখে গেলেন তা দুহাত ভরে গ্রহণ করুক পরবর্তী বিজ্ঞানী গবেষক প্রজন্ম।

২০২০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর করোনায় ৮৯ বছরের ডঃ অমলেশ চৌধুরী প্রয়াত হন, না কোনো লাল নীল বাতি ওলা গাড়ি আসেনি, এমনকি পরিবারের কেউ শেষ দেখাটুকু দেখতে পারেননি। একি কম আফশোষের? তিনি যাপনের মধ্য দিয়ে প্রতি মুহুর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন সহজভাবে, সাবলীলভাবে, অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবন আপন গ‍‌তিতে এগিয়ে নিয়ে চলা কত কঠিন, যা প্রতিনিয়ত শিক্ষনীয় এই নেটের দুনিয়ার এতবড় ব্যক্তিত্বের কোনো ওয়েবসাইট নেই, নেই কোনো তাঁর কাজের অনলাইন রেকর্ড, কিন্তু দেশের মাটি জানে, নদী সমুদ্র মোহনা উপকূল, বদ্বীপ, সামগ্রিক ভৌগোলিক রেখাচিত্রে তাঁর ছোঁয়া তোলা রইলো।

Comments :0

Login to leave a comment