অনিন্দিতা দত্ত — শিলিগুড়ি
উত্তরকন্যা অভিযানকে ঘিরে আরো একবার লাল ঝান্ডার পতাকাতলে একজোট হলেন উত্তরবঙ্গের মিড ডে মিল কর্মীরা। মঙ্গলবার ভোর থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আকাশের মুখ ভার। সূর্যের দেখা নেই। বেলা বাড়তেই একটু একটু করে রোদের উঁকিঝুকি শুরু। এই পরিবেশেই এদিন বেতন বৃদ্ধির দাবি সহ মোট ১৩দফা দাবিকে সামনে রেখে সিআইটিইউ অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের ডাকে উত্তরকন্যা অভিযানে সামিল হলেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মিড ডে মিল কর্মীরা। উত্তরকন্যা অভিযানকে সামনে রেখে এদিন মিড ডে মিল কর্মীদের সংগঠিত সুবিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্প কর্মীদের ন্যায় মিড ডে মিল কর্মীদের উৎসবকালীন অনুদান দেওয়া, অবিলম্বে বেতন বৃদ্ধি, ১০ মাসের পরিবর্তে ১২মাসের বেতন দেওয়া এবং নিয়মিতভাবে বেতন দেওয়া, বিদ্যালয়ের চতুর্থ কর্মীর মর্যাদা প্রদান, সমকাজে সমবেতন সাপেক্ষে ন্যূনতম ২১হাজার টাকা বেতন প্রদান, প্রত্যেক রন্ধন কর্মীকে পরিচিতিপত্র দেওয়া একাধিক দাবিতে মিড ডে মিল কর্মীদের দৃপ্ত মিছিল মাঝ রাস্তায় আটকে দিয়েছে পুলিশ।
এদিন সকালের পর থেকেই শহরের নৌকাঘাট মোড়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির রন্ধন কর্মীরা জমায়েত হতে শুরু করেন। এরপর দুপুর প্রায় দুইটা নাগাদ উত্তরকন্যা অভিযানের লক্ষ্যে মিড ডে মিল কর্মীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল উত্তরকন্যার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। লাল পতাকায় সুসজ্জিত মিছিল সুন্দরভাবে এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু নৌকাঘাট পেরিয়ে মিছিল তিনবাত্তি মোড়ের দিকে এগোতেই প্রশাসনের তরফে বাধাপ্রাপ্ত হয় মিছিল। বিরাট পুলিশ বাহিনী বাঁশের ব্যারিকেড গড়ে তুলে মিছিল আটকে দেয়। ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা হয়ে মিছিলের পথ। আর মিছিল বাধাপ্রাপ্ত হতেই পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের ধস্তাধ্বস্তি শুরু হয়ে যায়। রাস্তা অবরোধ করে দীর্ঘসময় ধ্বস্তাধ্বস্তি চলে। ন্যায্য দাবিতে উত্তরকন্যায় তারা দাবিপত্র পেশ করে আলোচনা করতে যাবেন। এই অনুরোধ করা সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসন কোন কথা শোনেনি। ব্যাপক প্ররোচনার সৃষ্টি করা হলেও প্রশাসনের অশান্তির চেষ্টার কোন প্ররোচনায় পা দেননি মিছিলকারীরা। অশান্তির চেষ্টা এড়িয়ে মিড ডে মিল কর্মীরা তিনবাত্তি মোড় লাগোয়া একটি ময়দানে গিয়ে দলে দলে সমবেত হতে শুরু করেন। এরপর সেখানে ধিক্কার সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্ররোচনা সৃষ্টিকারী পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে তিনবাত্তি হিন্দি জুনিয়ার স্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মিড ডে মিল ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সভাপতি কৃষ্ণা রায় চ্যাটার্জি বলেন, মিড ডে মিল কর্মীরা সারা বছরে ১২মাসের বেতনের পরিবর্তে মাত্র ১০ মাসের বেতন পেয়ে থাকেন। সমকাজ করেও তারা সমবেতন পান না। বছরের দুই মাস তো শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও ছুটি থাকে। তাঁর প্রশ্ন ছুটি কাটিয়ে যদি শিক্ষক শিক্ষিকারা বেতন পেতে পারেন তাহলে কেন রন্ধনকর্মীদের দুইমাসের বেতন কেটে দশ মাসের বেতন দেওয়া হচ্ছে। কারণ তারা রান্নার কাজ করেন তাই। মিড ডে মিল কর্মীদের সারা বছরে ১২মাসের বেতন দেবার দাবি জানান তিনি। বলেন, সুপ্রিম কোর্টে আমরা জানিয়েছিলাম শ্রমজীবি অংশের এই মহিলারা খুবই কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করছেন। ন্যূনতম ২৬হাজার টাকা দেওয়া না হলে তাদের চলছে না। মোটা ভাত কাপড়ে বেঁচে থাকতে হলে তাদের ন্যূনতম মজুরি দিতেই হবে সরকারকে। সমাজের অন্য অংশের শ্রমিকেরা উৎসব কালীন ভাতা পেয়ে থাকলেও আজ পর্যন্ত মিড ডে মিল কর্মীরা কোন ধরনের ভাতা পাননি। মিড ডে মিলের রন্ধন কর্মীদের সম্মানের প্রতিও সরকার উদাসীন। একটি পরিচয়পত্র, অপ্রোন, টুপি, নির্দিষ্ট পোষাক থাকলে রন্ধনকর্মীরাও সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করতে বাঁচতে পারেন। মিড ডে মিল কর্মীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ধারাবাহিকভাবে লড়াই আন্দোলন চলবে।
সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদিকা মধুমিতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির জমানায় অতি অল্প টাকায় কাজ করছেন রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের মিড ডে মিলের রন্ধন কর্মীরা। কেন্দ্রের তরফে ১ হাজার ও রাজ্যের তরফে মাত্র ৫০০ টাকা মিলিয়ে মোট ১৫০০ টাকায় স্কুলে স্কুলে রাধুনীর কাজ করছেন শ্রমজীবি মহিলারা। ২০১৩সালের পর থেকে দীর্ঘ দশ বছর পরেও তাদের বেতনের কোন হেরফের হয়নি। কোন বেতন বাড়েনি। একেবারে প্রত্যন্ত গরীব ঘরের মহিলারা স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিলে রান্নার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। অবিলম্বে ন্যুনতম ২১ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে রন্ধন কর্মীদের। তা না হলে আপাতত ৮ হাজার টাকা বেতন সহ উৎসবকালীন অনুদান দেবার দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা ও বিধিবদ্ধ ছুটি দেবারও দাবি জানান তিনি। মিড ডে মিলে কর্মীদের প্রতি দুই সরকারের বঞ্চনার প্রতিবাদে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। গরীবকে বঞ্চিত করে শোষন করে মেলা খেলা উৎসবের নামে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টাকার নয়ছয় করছেন। তাই জনগনকে ভয় পাচ্ছেন। তাই রাজ্যের সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করতে গেলেও বাধার সৃষ্টি করছে। তার ফল স্বরূপ এদিনের শান্তিপূর্ণ মিছিল আটকে দেওয়া হয়েছে। গোটা রাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আগামী ৯ অক্টোবর কলকাতার বিকাশ ভবন শিক্ষা দপ্তর অভিযান করা হবে।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সভার সভাপতি তথা সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি সুনীল নাটি, সিআইটিইউ দার্জিলিঙ জেলা সভাপতি গৌতম ঘোষ ও সম্পাদক সমন পাঠক প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য কমিটির সদস্য মদন সাহা, নৃপেন খাসনবিশ, ইন্দ্রানি মুখার্জি প্রমুখ। উত্তরকন্যা অভিযান ও ডেপুটেশন দেওয়াকে কেন্দ্র করে এদিন মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার রন্ধনকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সভা চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল উত্তরকন্যায় পৌঁছে স্মারকলিপি তুলে দেন।
শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড বাতিল সস ১৩ দফা দাবিতে এদিন উত্তরকন্যার অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারির হাতে স্মারকলিপিটি তুলে দেওয়া হয়েছে। উত্তরকন্যার অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি এদিন স্মারকলিপি গ্রহণ করে দাবি বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
Comments :0