চারজন বাউন্সার এবং পুলিশি নিরাপত্তা নিয়েই এতদিন ধরে ঘুরতেন তিনি। এবার নাকি ‘নিরাপত্তার’ ভয় পাচ্ছেন! শুক্রবার আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন আরজি কর কাণ্ডে ধিক্কৃত, মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ।
‘নিরাপত্তার কারণে’ তিনি নাকি সিবিআই তলবেও হাজিরা দিতে পারছেন না! আদালতে দাঁড়িয়েই বৃহস্পতিবার সেকথা যখন জানাচ্ছেন তাঁর আইনজীবী, তার কিছু পরেই স্বাস্থ্য ভবনের সামনে থেকে সেই সন্দীপ ঘোষকে সিজিও কমপ্লেক্সে তুলে নিয়ে আসেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকরা।
তারপরে এদিন দুপুর তিনটে থেকে দফায় দফায় চলছে জেরা। গভীর রাত পর্যন্ত আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষকে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোতে দেখা যায়নি। জানা যাচ্ছে, তাঁর বয়ানে গুরুতর অসঙ্গতি রয়েছে। তদন্তে এবং জেরায় অসহযোগিতারও অভিযোগ উঠছে। হাসপাতালের প্রধান হিসাবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে যে ভুরি ভুরি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তার বিশ্বাসযোগ্য জবাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এড়িয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করার সম্ভাবনা বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তদন্তে নেমেই আরজি কর কাণ্ড ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ বলেই মনে করছেন সিবিআই’র আধিকারিকরা। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বুঝতে চাইছেন, শুধুই ধর্ষণ, নাকি কোন ব্যাপারে ‘উপযুক্ত শাস্তি’ দিতেই তরুণী চিকিৎসকের ওপর সেদিন হামলা চালানো হয়েছিল? নিহত চিকিৎসক কি এমন কিছু জেনে গিয়েছিলেন, যার কারণেই তাঁকে এমন নৃশংসভাবে সরিয়ে দেওয়া হল? ঘটনার পরেই পরিকল্পিতভাবে পুলিশের তরফে কেন ভাসিয়ে দেওয়া হলো যে মৃত্যুর পরে ধর্ষণ করা হয়েছিল? ঘটনার পরেও সারা রাত ধরে গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কৌশলে কি যুক্ত ছিল হাসপাতালের প্রভাবশালী কেউ? ধর্ষণ করে খুনের পরেও প্রায় পাঁচ ঘন্টা সকলের অগোচরে কিভাবে পড়েছিল দেহটি? একগুচ্ছ এমন প্রশ্নের মুখেই দাঁড়িয়ে তদন্ত।
শুক্রবার একদিকে সন্দীপ ঘোষ এবং আরেকদিকে বিভাগীয় প্রধান অরুণাভ দত্ত চৌধুরিকে দফায় দফায় জেরায় উঠে এসেছে একাধিক অসঙ্গতি। বিশেষত সরকার-ঘনিষ্ঠ সন্দীপ ঘোষের জেরাপর্ব তদন্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
যদিও এর আগে কলকাতা পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয়নি আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে। পুলিশি নিরাপত্তাও বহাল ছিল। যার ভূমিকায় শুধু সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসকরা শুধু নন, রাজ্য জুড়ে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তাঁকে বাদ রেখেই কলকাতা পুলিশের তদন্ত ‘‘এগিয়ে চলছিল’’! এমনকি আরজি করে ‘ইস্তফা’ ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাঁকে পুরস্কৃত করে কলকাতারই আরেক গুরুত্বপূর্ণ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বানিয়ে দিয়েছিল মমতা-সরকার।
এর আগে যেমন একাধিক দুর্নীতির তদন্ত এড়াতে অভিযুক্ত তৃণমূলী নেতা-মন্ত্রীদের বারেবারে আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা গিয়েছে, শুক্রবার সেই কৌশলেই তড়িঘড়ি হাইকোর্টে যান এই প্রাক্তন অধ্যক্ষ। পুলিশি নিরাপত্তার আর্জি জানিয়ে দ্রুত শুনানি চেয়ে আবেদন জানান। তবে শুক্রবার কোন নির্দেশ দেননি বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ। এদিনই আবার আরজি করে চারতলায় সংস্কারের নামে ঘর ভাঙা এবং ১৪ তারিখ রাতে ভাঙচুর সংক্রান্ত মামলা শোনে ডিভিশন বেঞ্চ। সেখানেও সন্দীপ ঘোষের আইনজীবী নিরাপত্তার আর্জি জানালে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি খুবই ক্ষমতাশালী। আপনি আমাদের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করছেন। রাজ্যকে বলুন নিরাপত্তা দিতে। আপনি তো প্রভাবশালী। ৫০০ পুলিশ দিয়ে দেবে। না হলে আদালতের কাছে আসুন। কেন্দ্রীয় বাহিনী না হয় আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি’’
আদালতের মনোভাব টের পেয়েই এরপর কৌশল বদলান সন্দীপ ঘোষ। সকালেই তিনি চলে আসেন স্বাস্থ্য ভবনে। এক সপ্তাহ আগেও স্বাস্থ্য ভবনে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। শুক্রবারও সিজিও’তে হাজিরা না দেওয়ায় সিবিআইয়ের তরফে ফের তাঁকে যোগাযোগ করা হয়। তখন বাধ্য হয়ে সন্দীপ ঘোষ জানান, স্বাস্থ্য ভবনে আছেন। এরপরেই সিবিআই’র তরফে বলা হয়, সেখান থেকে বেরিয়ে যেন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি আসেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও সিবিআই আধিকারিকরা সেখান থেকেই তাঁকে গাড়িতে তুলে সোজা চলে আসে সিজিও কমপ্লেক্সে। তখন সেখানেই চলছিল অরুণাভ দত্ত চৌধুরীর জেরাপর্ব।
জানা গিয়েছে, জেরায় একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে সন্দীপ ঘোষকে। সিবিআই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে, কেন হাসপাতালে এত বড় নৃশংস ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়নি? তিনি কখন ঘটনার খবর পেয়েছেন? সেদিন রাতে কতক্ষণ নিজের অফিসে ছিলেন? বিভাগীয় প্রধানকে মৃতার বাড়িতে কী তিনিই খবর দিতে বলেছেন? তাহলে সহকারী সুপার কেন মৃতার বাড়িতে ফোন করে আত্মহত্যার কথা বলেছিলেন? তিনি পরের দিন সকালে কখন হাসপাতালে আসেন? ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিককালে কোন সমস্যা হয়েছিল? সিংহভাগ প্রশ্নেই তাঁয় দায়সারা জবাবে তদন্তকারীদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হচ্ছে বলে খবর।
বৃহস্পতিবারও সিবিআইয়ের তলবে হাজিরা দিয়েছিলেন অরুণাভ দত্ত চৌধুরি। এদিন ফের সকাল থেকে চলে দফায় দফায় জেরা। এর আগে অরুণাভ দত্ত চৌধুরি দাবি করেছিলেন, তিনি ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত কর্মীর কাছ থেকে ঘটনার কথা শুনেছিলেন। তারপর তিনিই ফোন করে খবর দিয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠকে। তাঁরা জানান, খবরটি ইতিমধ্যেই তাঁরা পেয়েছেন। তাঁরাও পৌঁছচ্ছেন ঘটনাস্থলে। সেখানে পৌঁছে মৃতদেহের দিকে তাকাতে পারেননি বলে দাবি করেছেন অরুণাভ। ঘটনার পরে সেমিনার হলের কাছের অন্য একটি ঘর কেন ভাঙা হচ্ছিল, সে প্রসঙ্গে বিভাগীয় প্রধান সংবাদমাধ্যমের কাছে জানিয়েছিলেন, ভাঙার কাজে তাঁর অনুমতি নেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে দাবি, আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসক সহ হাসপাতালে চেস্ট মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান, সহকারী সুপারের বয়ানে একাধিক ফাঁক ও অসঙ্গতি রয়েছে।
Dr Sandip Ghosh
রাতেও জেরা চলছে সন্দীপের
×
Comments :0