সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়: হাওড়া
একসময়ে শস্য ভাণ্ডার হিসাবে পরিচিত ছিল শ্যামপুর। রূপনারায়ণ নদের পাড়েই এই জনপদ। চাষাবাদই ছিল ভরসা। কিন্তু এখন কৃষক পরিবারের কেউই আর খেতের কাজ করতে চাইছেন না। পা বাড়াচ্ছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। যদিও রোজগার তেমন নেই সেখানেও। পেটের তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গ্রামীণ এলাকা শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। শুধু শ্যামপুর নয়, একদিকে শিল্পাঞ্চল এবং অন্যদিকে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল ঘেরা হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই জনবিন্যাসগত, পেশাগত পরিবর্তন ঘটেছে কয়েক বছরে। সেই পরিবর্তন এবং তার জেরে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেই ছবিই শুক্রবার সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা কমিটির সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রতিনিধিদের আলোচনায় ফুটে উঠল। আশার কথা, এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সন্ত্রাস মোকাবিলা করে পার্টিকর্মীরা গ্রাম-গঞ্জেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বহু ঘরছাড়া কর্মীকে ঘরে ফেরানোও সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। বিদায়ী সম্পাদক দিলীপ ঘোষ খসড়া সাংগঠনিক রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করেও এই জনবিন্যাসগত পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। উদ্বোধনী ভাষণে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অনাদি সাহু বলেছেন, ‘যে হাওড়া, হুগলী, আসানসোল শিল্পাঞ্চল দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, সেগুলি আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে।’
সম্মেলনের প্রতিনিধি এবং নেতৃবৃন্দদের বক্তব্যে দেশ, রাজ্যের পাশাপাশি দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদী আগ্রাসন, শ্রমিক-কৃষক সহ আপামর সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা বারবার ফিরে এসেছে। এদিন প্রতিনিধিদের আলোচনার পর পর্যবেক্ষণ দিতে গিয়ে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবব্রত ঘোষ বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেককে মাথায় রাখতে হবে, মানুষের জন্যই পার্টি। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার কাজ গণ তৎপরতার সঙ্গে করতে হবে।’
হাওড়ায় অনিল বিশ্বাস ভবনে পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির ২৫তম সম্মেলন শুরু হয়েছে এদিন। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি মঞ্চ এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগরে সম্মেলন চলবে শনিবার পর্যন্ত। সম্মেলন উপলক্ষে এই নামকরণ করা হয়েছে। এদিন সকালে গণসঙ্গীত পরিবেশনের পর পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসু। তারপর শহিদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানান নেতৃবৃন্দ। তারপর শুরু হয় সম্মেলনের কাজ।
দুনিয়াজুড়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির আগ্রাসন, দেশ ও রাজ্যের পরিস্থিতি এবং নির্দিষ্টভাবে হাওড়া জেলার অবস্থা তুলে ধরেন অনাদি সাহু। তিনি বলেন, ‘শুধু সামাজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, চিন্তাভাবনার জগৎকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করে চলেছে ফ্যাসিবাদী শক্তি। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। আর সেই সঙ্কটের বোঝা শ্রমিক শ্রেণির উপরই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে সঙ্ঘ-বিজেপি’র এই সাম্প্রদায়িক শাসনকালে পুঁজিপতিদের স্বার্থে লুট করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এক অংশের মানুষের হাতে সর্বাধিক সম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির চরিত্রই মুনাফা বৃদ্ধি করা।’ দেশ এবং রাজ্যের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, ‘গত ১৩ বছরে মোদীর রাজত্বে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কী দুরবস্থা তা প্রতিদিন পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। স্থায়ী কর্মসংস্থান তুলে দিয়ে কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে। এ রাজ্যেও একই অবস্থা এবং অবশ্যই হাওড়ার ছবিও তাই। হাওড়া, হুগলি, আসানসোল শিল্পাঞ্চল একসময় গোটা দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কৃষকরাও একইভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু ফসলের ন্যায্য দাম কৃষকরা পাচ্ছেন না। দেশজুড়েই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তীব্র মন্দা দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের আয় কমছে। বেকারত্ব বাড়ছে, শিল্পে বিনিয়োগ নেই। ফলে পুঁজিবাদ কখনওই ভবিষ্যৎ হতে পারে না। এ রাজ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস সরকার যে সন্ত্রাস, গুণ্ডামি চালাচ্ছে এবং যেভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাসী শাসন কায়েম করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে যেমন লড়ে যেতে হবে তেমনই দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকেও মোকাবিলা করতে হবে।’
রিপোর্ট পেশ করে বিদায়ী সম্পাদক দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্তরে পুঁজিবাদের যে বিপদ ঘনিয়েছে, আমরা তার বাইরে নই। আমাদের শ্রেণিবোধ, শ্রেণিচেতনায় বারবার আঘাত হানা হচ্ছে। রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি একে অপরের বি-টিম হিসাবে কাজ করে। ফলে দুই শক্তিকেই পরাস্ত করতে হবে। জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি-কে কিছুটা ধাক্কা দেওয়া সম্ভব হলেও মনে রাখতে হবে তাদের একেবারে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। একদিকে জীবন জীবিকার উপর আক্রমণ এবং অন্যদিকে বিভাজন, এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সম্ভাবনাও আছে। আমাদের শ্রেণিচেতনা আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। মিডিয়াকে হাতিয়ার করে দুই দল যে বিষ সাধারণ মানুষের মনে ঢোকাচ্ছে, তা বামপন্থার ভাষ্য দিয়েই বের করতে হবে। আমাদের জেলার ভৌগোলিক পরিবর্তনের জন্য আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনও হয়েছে। মানুষের থেকে শিক্ষা নিয়েই মানুষকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এই সম্মেলন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উপযোগী আন্দোলনের দিশা দেখাবে।’
প্রতিনিধিদের আলোচনার প্রেক্ষিতে দেবব্রত ঘোষ বলেছেন, ‘মানুষের জন্যই পার্টি। আমাদের প্রত্যেককে একথা মাথায় রাখতে হবে। যত বড় বড় আলোচনাসভাই হোক না কেন, যে শ্রেণিভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে পার্টি তৈরি, সেই মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে। কৃষক, খেতমজুর, অসংগঠিত শ্রমিক, বস্তিবাসী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি হতে পারে। একাজগুলি তখনই করতে পারব যখন বুঝতে পারব এটা করা প্রয়োজন। উপলব্ধি, মতাদর্শগত চেতনার মধ্যে দিয়ে সেই রাজনৈতিক স্বচ্ছতার জায়গায় পৌঁছাতে হবে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজ করতে হবে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্রবেশ করতে হবে। গণ তৎপরতা সবদিক দিয়ে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মানুষ বাদ দিয়ে কিছু হবে না।’
প্রতিনিধিদের আলোচনা থেকে এদিন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। বিভিন্ন এরিয়া কমিটির প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিজেপি এবং তৃণমূল দুই রাজনৈতিক দলই ফ্যাসিস্ত। ফলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এদের প্রতিহত করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সম্প্রতি আর জি কর হাসপাতালের নৃশংসতা এবং তার পরের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রসঙ্গও এসেছে আলোচনায়। উঠে এসেছে, এই খুন-ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনজাগরণের কথাও। এসেছে মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ, সংবিধান প্রণেতা বি আর আম্বেদকরকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের অসম্মানজনক মন্তব্য, এক দেশ এক ভোট নীতির মতো জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুতর বিষয়গুলি। ছাত্রনেতা আনিস খান খুন এবং তারপরে লাগাতার যে আন্দোলন চলেছে হাওড়াজুড়ে এবং সেই আন্দোলনে স্থানীয় মানুষজনের থেকেও যে সাড়া পাওয়া গিয়েছে, সেকথাও বলেছেন প্রতিনিধিরা। জমি-বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, সম্পত্তি দখল করে নেওয়া, পুকুর ভরাট করে হোটেল-লজ তৈরি করা হচ্ছে, বিশুদ্ধ পানীয় জল না পাওয়া সহ জনসাধারণের নিত্যদিনের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলি তুলে ধরেছেন তাঁরা। একইসঙ্গে বলেছেন, সমস্ত দিক দিয়ে সমাজের যে অবক্ষয় হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারেন একমাত্র কমিউনিস্টরাই।
সম্মেলন পরিচালনার জন্য পরেশ পাল, স্বপ্না ভট্টাচার্য, মোহন্ত চ্যাটার্জি, সাবিরুদ্দিন মোল্লা এবং অশোক দলুইকে নিয়ে ৫ জনের সভাপতিমণ্ডলী তৈরি হয়েছে। আর জি কর হাসপাতালে নিহত চিকিৎসক, ছাত্র নেতা আনিস খান সহ শহিদ স্মরণে প্রস্তাব নেওয়া হয়। পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ রাজ্য, দেশ এবং বিশ্বে সাম্প্রতিককালে হারানো প্রত্যেকের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
Comments :0