Change Will Come

পরিবর্তন আসবেই

সম্পাদকীয় বিভাগ

Change Will Come

আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির কাছে সমাজ পরিবর্তনের অর্থ কেবলমাত্র পুরানো উৎপাদন ব্যবস্থার জায়গায় নতুন একটা উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তর নয়। কিংবা নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার অনুসারী নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার নির্মাণ নয়। কোনও সন্দেহ নেই, সমাজ পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্ত পুরানো উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো এবং নতুন অর্থনীতির জন্য নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণ। তবে শ্রমিকশ্রেণির কাছে এই পরিবর্তনের লক্ষ্য হলো শ্রেণি শোষণ ও শ্রেণি শাসনের উচ্ছেদ করে শ্রেণিহীন সমাজের দি‍‌কে এগিয়ে চলা।
শোষণহীন শ্রেণিহীন সমাজের দিকে এগিয়ে চলার কোনও সহজ সরল পথ নেই। জয় ও পরাজয়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এগিয়ে চলা। তবে এগিয়ে চলার পথটি ইতিহাসের ধারায় সম্ভাবনাপূর্ণ এবং অবশ্যই অনিবার্য। ‘অনিবার্য’ শব্দের উল্লেখকে নির্ধারণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে গুরুতর ভুল হয়ে যেতে পারে। এই শব্দটিকে বিচার ও ব্যবহার করতে হবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সৃষ্টিশীল দৃষ্টিতে। সমাজ পরিবর্তনের একটা সাধারণ নিয়ম আছে। তবে তা ছকবাঁধা নিয়মে চলে না। পৃথিবীর কোথাও সমাজ পরিবর্তন পূর্ববর্তীটির রেপ্লিকা হয় না, হয়নি এবং হবেও না। এটাই মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা।
ইতিহাসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতি মানবসমাজের বিকাশের যে ইতিহাস তুলে ধরেছে, তাতে আধুনিক সমাজের পরস্পর বৈরি শ্রেণি দু’টি হলো বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বিপ্লবী সম্ভাবনাময়পূর্ণ ফ্রান্সের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে আধুনিক শিল্প সমাজের পরস্পর মুখোমুখি নতুন প্রধান শ্রেণি দুটির বর্ণনা রয়েছে। রয়েছে ‘মধ্যশ্রেণি’ ও তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার স্পষ্ট ইঙ্গিত। আজ একুশ শতকের তৃতীয় দশকের গোড়ায় সমাজ পরিবর্তন বিষয়ে চর্চা ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে নতুন পৃথিবীর নতুন নতুন উপাদানের সঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস বর্ণিত আধুনিক শ্রেণি সম্পর্কের সম্ভাবনাগুলির যথার্থতা রয়েছে। এবং অবশ্যই পর্যালোচনা ও সৃষ্টিশীল পুনঃচর্চা প্রয়োজন।
মানব সমাজ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পৌঁছেছে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমে। সেই বিচারে বুর্জোয়া বিপ্লব হলো পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব। এ বিশ্বে মানব সমাজে ‘আধুনিকতা’ হলো বিপ্লবের সন্ধান। মার্কস-এঙ্গেলস বারে বারে আধুনিক যুগের ঊষালগ্নে বুর্জোয়াদের প্রগতিবাদী ও বিপ্লবী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বুর্জোয়া যুগের উদ্ভব ঘটলেও তা ছিল শ্রেণি শাসন ও শ্রেণি শোষণের ব্যবস্থা। তাই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদের সংগ্রামে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি হলো বিপ্লবী শ্রেণি। একশো চুয়াত্তর বছর পেরিয়ে আজকের পুঁজিবাদী পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। ম্যা‍‌নিফেস্টোর সাধারণ বোঝাপড়ার সঙ্গে বদলে যাওয়া পৃথিবীর শ্রেণি সম্পর্কের পরিবর্তনশীলতার সঠিক উপলব্ধির মাধ্যমে আজকের পৃথিবীর বিপ্লবীদের চিন্তা ও কাজ অর্থাৎ তত্ত্ব ও প্রয়োগের সৃষ্টিশীল বিকাশ ঘটাতে হয়। সৃষ্টিশীল বিকাশের অর্থ ম্যানিফেস্টো কিংবা মার্কসীয় দর্শনের ক্ল্যাসিকস্‌কে বাতিল করা নয়, বরং দু’হাজার বাইশের নভেম্বরে এদেশ এরাজ্যে পরিবর্তনের সংগ্রামে ই‍‌শ্‌তেহার দিশা দেখায় বিপ্লবীদের। ম্যানিফেস্টো এবং মার্কসীয় দর্শনের ক্ল্যাসিকস্‌ দিশা দেখায় বিপ্লবীদের।
ম্যা‍‌নিফেস্টোর প্রথম অধ্যায় (বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত), দ্বিতীয় অধ্যায় (প্রলেতারীয় ও কমিউনিস্টরা) এবং চতুর্থ বা শেষ অধ্যায় (বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধী পার্টির সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান) থেকে কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ‘বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের লড়াইটা মর্মবস্তুতে না হলেও আকারের দিক থেকে হলো প্রথমত জাতীয় সংগ্রাম। প্রত্যেক দেশের প্রলেতারিয়েতকে অবশ্যই সর্বাগ্রে হিসাব মেটাতে হবে নিজের দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে।’
‘কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য ... প্রলেতারিয়েতকে শ্রেণিরূপে গঠন করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার।’
‘আপন মতামত ও লক্ষ্য গোপন রাখতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা বোধ করে। খোলাখুলি তারা ঘোষণা করে যে, তাদের অভীষ্ট অর্জিত হতে পারে কেবল সমস্ত বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার সবল উচ্ছেদ ঘটিয়েই।’
ম্যানিফেস্টো প্রকাশের ছয় দশক পরে এ‍‌ই শব্দগুলোর সফল বাস্তবায়ন ঘটেছিল ১৯১৭-র নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠিত হলো ‘বুর্জোয়ার পতন এবং প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দুই-ই সমান অনিবার্য।’ নভেম্বর বিপ্লবের পর পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণির সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম ক্রমশ বিকশিত হয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বের বিকল্প সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে মাটির পৃথিবীতে মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধিতে উপস্থিত করেছিল। আমাদের দেশ সহ সারা পৃথিবীতেই উপনিবেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে গুণগতভাবে উন্নত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে সমাজতন্ত্র ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শক্তিশালী ভূমিকা মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে নিদর্শন হয়ে আছে এবং থাকবে। তবে আজকের পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের এই দুটি উপাদান কার্যত অনুপস্থিত। তবে কি আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের ‍‌নিগড়ের বাইরে মুক্তির স্বপ্ন দেখা সম্ভব? সত্যিই কি পুঁজিবাদের উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে দেশে দেশে পরিবর্তনের সংগ্রামের অস্তিত্বের বাস্তবতা আছে? আবেগের বিনিয়ন্ত্রণকে দূরে রেখে শান্ত অথচ ঋজুভাবে বলা যায়, হ্যাঁ আজকের পৃথিবীতেই মানুষের মুক্তির সংগ্রাম সম্ভব।

মার্কসবাদের নির্দিষ্ট প্রয়োগ 
মার্কসবাদীকে মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা উপলব্ধি করতে হয়, শ্রমিকশ্রেণি সহ পৃথিবীর সমস্ত মেহনতি মানুষের স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এ‍‌ই দায়বদ্ধতা বলতে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আস্থা বোঝায় না। মার্কসবাদ হলো প্রকৃতি জগৎ, মানব সমাজ ও ব্যক্তি মানুষকে বিচার করার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী পদ্ধতি। মার্কসবাদে তত্ত্ব ও প্রয়োগের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক। সে কারণে মার্কসীয় সাহিত্যে বর্ণিত শব্দ, লাইন ও অনুচ্ছেদগু‍‌লিতে আটকে থাকাটা কোনও মার্কসবাদীর কাজ নয়। মার্কস-এঙ্গেলস থেকে কোনও মার্কসবাদীই তা বলেননি। মার্কসীয় দর্শনের মর্মবস্তুকে নিজের সময়ে নিজের কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার দক্ষতা ও ইচ্ছে অর্জন করতে হয় প্রতিটি মার্কসবাদীকে। এ‍‌ই দক্ষতা অর্জন করতে গেলে একদিকে যেমন মার্কসীয় দর্শনকে উপলব্ধি করতে হয়, পাশাপাশি বর্তমান সময়ে পরিবর্তনশীল পৃথিবী ও সমাজের শ্রেণি সম্পর্কগুলির পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। সঠিকভাবে এটা করতে পারলেই শ্রমিকশ্রেণি সহ শ্রমজীবী জনগণ ও মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি আস্থা শ্রেণি শত্রুর প্রতি ঘৃণা এবং পরিস্থিতির উপযোগী সৃষ্টিশীল হওয়া সম্ভব। শ্রেণি ও দর্শনের প্রতি আস্থা এবং পরিস্থিতির উপযোগী সৃষ্টিশীল দক্ষতা ও ইচ্ছে গড়ে উঠলে যে কোনও মার্কসবাদীর মধ্যে এই আস্থা অর্জন করা সম্ভব যে আজকের পৃথিবীতেও মানবমুক্তির সংগ্রাম হলো বাস্তব ঘটনা। যতদিন সমাজে শ্রেণি শোষণ থাকবে ততদিন সজীব থাকবে শ্রমিক শ্রেণির সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য ও সংগ্রাম। বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়েও ১৮৪৮ সাল থে‍‌ক ১৮৫০-এ ফ্রান্সে শ্রমিকদের শ্রেণি সংগ্রামের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে মার্কস লিখলেন: ‘কয়েকটি মাত্র অধ্যায় বাদে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত বিপ্লবের ইতিহাসের প্রতিটি গুরুতর অংশের শিরোনামা হচ্ছে বিপ্লবের পরাজয়’।
‘এইসব পরাজয় যার পতন হলো, তা কিন্তু বিপ্লব নয়। পতন হয়েছিল প্রাকবিপ্লবী চিরাচরিত লেজুরগুলির, যাদের উদ্ভব সেই সামাজিক সম্পর্কাদি থেকে যা তখনও পর্যন্ত তীব্র শ্রেণিসংঘাতের পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি— ব্যক্তি, বিভ্রম, প্রত্যয়, পরিকল্পনা যেসবের হাত থে‍‌কে ফেব্রুয়ারি  বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত বিপ্লবী দল মুক্ত ‍‌ছিল না, যার  থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব ফেব্রুয়ারির বিজয়ের ফলে নয়, একমাত্র উপর্যুপরি কয়েকটি পরাজয়ের মারফতই।’
আজও পৃথিবীর বড় অংশে এই কথাগুলি সত্য। মার্কসের এই রচনার পরে পৃথিবী ১৮৭১-এ প্যারি কমিউন  গঠন ও তার ব্যর্থতা এবং ১৯০৫-র ব্যর্থ  রুশ বিপ্লব দেখেছে। তারপরেও  ১৯১৭-র নভেম্বর দুনিয়া কাঁপানো দশদিন দেখেছে পৃথিবী। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে বিপ্লবের জন্য বিপ্লবী শক্তির বিষয়ীগত প্রস্তুতিও  লাগে। নভেম্বর বিপ্লব এবং অন্য সমস্ত সকল বিপ্লবের এটাই শিক্ষা। বিপ্লবীদের প্রধান কাজ শ্রমজীবীদের শ্রেণি হিসাবে‍‌ সংগঠিত করা, সে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে এবং এটা ছাড়া তার বিকল্প কিছু নেই, তা বোঝানো। তাই শ্রমিক ও সমস্ত শ্রমজীবীদের মধ্যে সংগঠিত চেতনা  ও মতাদর্শ বাইরে  থেকে নিয়ে যেতে হয়। এই কাজও সংগঠিত বাহিনী হিসাবে শ্রমিকশ্রেণিকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কমিউনিস্ট পার্টির। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা  শ্রমিকদের রাজনীতি-সচেতন করে এবং লড়াই-সংগ্রা‍‌মের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের পথে যুক্ত করে। প্রকৃত মার্কসবাদী হয়ে ‍‌ওঠার সংগ্রামে ঘাটতি থাকলে এই কথাগুলিকেই অসার-অবাস্তব মনে হতে পারে।

শ্রেণির রূপে বদল 
আজকের পৃথিবীতে শ্রেণিভারসাম্য শ্রমিকশ্রেণি  ও শ্রমজীবীদের বিপক্ষে। শুধুমাত্র বিপক্ষে নয়, তীব্রভাবেই প্রতিকূল।  পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের আজকের চেহারা লুটেরা। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি শক্তিশালী আধিপত্যের স্তরে রয়েছে।‍‌ এই আধিপত্যের অনুসারী তীব্র দক্ষিণপন্থী, নয়া  ফ্যাসিবাদী‍‌ রাজনৈতিক প্রবণতা বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান। আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একদিকে পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে তীব্রতর করা এবং অন্যদিকে সর্বোচ্চ  মুনাফার জন্য শোষণের নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলিকে জোর করে খুলে‍‌ দেওয়া। এই দুটি কাজ করার জন্য পুঁ‍‌জিবাদের শোষণমূলক সঞ্চয়নের পরিবর্তে বলপূর্বক সঞ্চয়ন চলছে। কেমনভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য সংগ্রহের মাধ্যমে পুঁজিবাদ মুনাফা অর্জন করে, মার্কস তা  ‍‌দেখিয়েছেন। উদ্বৃত্ত সংগ্রহের প্রক্রিয়া অমানবিক হলেও তাতে সংগঠিত শ্রমিকের অস্তিত্ব ‍‌ ও কাজের  সম্ভাবনা থাকতো। আজ নতুন নতুন ক্ষেত্রে মুনাফা সংগ্রহের  জন্য পুঁজিবাদী পদ্ধতি হলো উৎপাদনের ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে সার্বিক ফাটকাকরণ থেকে সার্বিক  লুণ্ঠন। অর্থনীতির পণ্ডিতরা যাকে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ধান্দার ধনতন্ত্র বলে উল্লেখ করছেন। নয়া উদারবাদের চলতি তিন দশকের গতিতে প্রথমে উৎপাদনের ক্ষে‍ত্রে স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হয়েছে। ক্রমশ উৎপাদনের ক্ষেত্র ধ্বংসের ফলে শ্রমিকের অস্তিত্বই ‍‌বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এমনিতেই পুঁজিবাদে শ্রমশক্তিকে  মজুত রাখা হয়। যাতে কর্মরতদের শ্রম সস্তায় কেনা যায়। যাদের আমরা ‘বেকার’ পরিচয়ে ডাকি। ক্রমহ্রাসমান কাজের ক্ষেত্র কিংবা কর্মহীনতার ফলে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি অসংগঠিত শ্রমিকে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং এই সংখ্যা প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান। তীব্র  বেকারি, ক্রমবর্ধমান অসংগঠিত শ্রমিক বা শ্রমজীবী  মানুষ শেষ পর্যন্ত কর্মরত সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দর-কষাকষির শক্তি এবং প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে অসংগঠিত শ্রমিক এবং শ্রমজীবীদের কাজ, আয়  ও প্রকৃত মজুরি ক্রমহ্রাসমান। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কট। পুঁ‍‌‍‌জিবাদী অর্থনীতিবিদরাও বলছেন বর্তমান এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনা আজকের নয়া উদারবাদে দেখা যাচ্ছে না। নয়া উদারবাদ কার্যত দেউলিয়া।
পুঁজিবাদই আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির জন্ম দি‍‌য়েছে। যদি আমরা নয়া উদারবাদের সূচনাকালকে আর একবার  মনে করি, তবে  বুঝতে পারবো একদিকে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ, অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্বকে বিপন্ন করার তাড়না থেকেই নয়া-উদারবাদের উৎপাদনের ক্ষেত্রকে লঘু করে মুনাফা অর্জ‍‌নের পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল। যা এখন ক্রো‍‌নি ক্যাপিটালিজমের স্তরে এসে পৌঁছে‍‌ছে। ফলে এই নয়া উদারবাদী পথে পুঁজিবাদেরও  বাঁচার রাস্তা নেই এবং গত তিন শতকে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি যে অবস্থায় ছিল, তাও আজ বিপন্ন। আজকের ‘ফিনান্স’ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির অর্থনীতিতে নতুন শব্দ চলে এসেছে— প্রিকারিয়েত। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ১৮৮৮’র ইংরেজি সংস্করণের টিকায় এঙ্গেলস প্রলেতারিয়েত শব্দের অর্থ বোঝাতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘প্রলেতারিয়েত হলো আজকালকার (পড়তে হবে সেই সময়ের উৎপাদনমুখী পুঁজিবাদ) মজুরি শ্রমিকরা, উৎপাদনের উপায় নিজেদের হাতে না থাকার দরুন যারা বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হয়।’ পুঁজিবাদের শোষণমূলক সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ায় যে শ্রমজীবীরা শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হয় তারাই প্রলেতারিয়েত। এদের যে শ্রমের মজুরি পুঁজিপতি দেয় না তা থেকেই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয়, মুনাফা নামক ‘নরমেধ যজ্ঞের ঘোড়া’ দৌড়তে থাকে। কিন্তু তবুও এরা শ্রম করার সুযোগ পেত, সংগঠিত হবার সুযোগ পেত, সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের সামনে ভবিষ্যতে জীবনের রূপরেখা ছিল। আজকের নয়া উদারবাদের সর্বগ্রাসী বাজার সর্বস্বতা, বিশেষত ফিনান্স নিয়ন্ত্রিত লুটেরা পুঁজিবাদে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাজ নেই, কাজ পাবার সম্ভাবনা নেই, বসবাস আর জীবনধারা সীমাহীন অনিশ্চয়তায় বাঁধা, হতাশা ও সমাজ বিচ্ছিন্নতা যাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান— এরাই হলো আজকের নয়া উদারবাদী সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতিতে প্রিকারিয়েত বলে পরিচিত। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বয়সে যুব। সমাজ অর্থনীতিতে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা এদের মধ্যে ক্ষোভ, ক্রোধ তৈরি করে। আবার আধুনিক প্রযুক্তির বিপুল পরিবর্তনের দিনে এরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পটু। এরা সংগঠিত নয়, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তি মাধ্যমে দ্রুত জড়ো হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। এই অংশ যেহেতু উৎপাদনের মধ্যে থাকার পরিবর্তে বাজার অর্থনীতির নেতিবাচক সামাজিক পরিমণ্ডলে থাকে তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজকের কর্পোরেট পুঁজির পাহারাদার দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এদের সহজেই ব্যবহার করতে পারছে। ক্ল্যাসিক পুঁজিবাদেও যুব জন অংশ যারা শ্রমিক হয়ে ওঠেনি তাদেরও শ্রমিকশ্রেণির অংশ হিসাবেই দেখা হয়। কারণ তারা মজুত শ্রমশক্তি। আজকের সংগঠিত ক্ষেত্রের ধ্বংসের প্রবণতা বৃদ্ধি, অসংগঠিত শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক, বেকার, আধা বেকার, ছদ্ম বেকার জনঅংশের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে চলেছে, যারা প্রায় সকলেই যুব জনঅংশ। কর্মহীন, আশাহীন অথচ বিপুল কর্মক্ষমতা নিয়ে থাকা এই শ্রমজীবী অংশকেই দেশে দেশে দক্ষিণপন্থীরা ব্যবহার করছে। আমাদের দেশ ও রাজ্যের আরএসএস/বিজেপি/তৃণমূল কংগ্রেস এই অংশকে ব্যবহার করছে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নসন্ধানীদের এই অংশকে নতুন ধারার পেশাগত আন্দোলন, পরিযায়ী শ্রমিকদের আন্দোলন, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বেঁধে বেঁধে রাখতেই হবে। শ্রমের বাজারে এই অংশই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের সংগঠিত করতে না পারলে শ্রমিকশ্রেণির দিনবদলের সংগ্রাম এগতে পারবে না বরং ধাক্কা খাবে। এখানেই আজকের পৃথিবীতে ভঙ্গুর উৎপাদন ব্যবস্থা অথচ পুঁজির বিপুল কেন্দ্রীভবনের দিনে পৃথিবীব্যাপী ও নিজের চারপাশের পরিবর্তিত শ্রেণি অবস্থানগুলির সুনির্দিষ্ট মূল্যায়নের ভিত্তিতে মার্কসতত্ত্বের সৃজনশীল বিকাশের প্রসঙ্গটি উপস্থিত হয়। আজ কপিবুক তত্ত্ব চর্চার কোনও জায়গা নেই। লেনিন, মাও, হো-চি-মিন সহ বিপ্লবীরা যদি তাঁদের সময় ও তাঁদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কপিবুক তত্ত্ব চর্চা করতেন তবে ন‍‌ভেম্বর বিপ্লব সহ শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের মহান বিপ্লবগুলি মাটির পৃথিবীতে সম্ভবপর হতো না। আজকের বাস্তবতায় মার্কসবাদ প্রয়োগের পথ খুঁজতে হবে। পথ তৈরি করে এগতে হবে।

শ্রমজীবীর লড়াইও বাড়ছে 
আজ আন্তর্জাতিক শ্রেণি ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের অনুকূলে। এটাই প্রধান, কিন্তু একমাত্র নয়। পৃথিবীব্যাপী লুটের অর্থনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। এবং তা ক্রমশ শক্তি অর্জন করছে। কোভিড পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেটগুলি যেমন মুনাফার সর্বোচ্চকরণ ঘটিয়েছে, তেমনই কোভিড বিশ্বে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক ও দেউলিয়া চেহারা আরও প্রকট হয়েছে। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে মাঠের লড়াই ও মগজের লড়াই তীব্রতর হচ্ছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন দেশেও অতিকায় কর্পোরেটগুলিতে শ্রমিক-কর্মচারী‍‌রা দ্রুতহারে ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত হচ্ছেন। পৃথিবীব্যাপী শ্রম ও পুঁ‍‌জির প্রাথমিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। মার্কিন দেশের এই ঘটনা তারই প্রতিফলন। একদিকে শ্রমিকদের আবার ক্রীতদাসে পরিণত করার শ্রম-আইন, ছাঁটাই, নতুন প্রযুক্তির ফলে শ্রমের স্থানান্তর ঘটছে, বিপরীতে আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনঅংশের প্রতিরোধ বাড়ছে। এটাই হলো আজকের পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণির অনুকূলে ভারসাম্য বদলের সংগ্রামের সব থেকে শক্তিশালী পৃষ্ঠভূমি। পৃথিবীতে কখনো কোথাও সমাজ বিপ্লব কিংবা শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আন্তর্জাতিক পরি‍‌প্রেক্ষিত নিরপেক্ষ হয়নি, হয় না। অবশ্যই জাতীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির প্রতিফলন ঘটে। এই প্রতিফলন একমুখী নয়, দ্বান্দ্বিক। আগে আমরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো উল্লেখ করে বলেছি শ্রমিক শ্রেণিকে প্রথমে তার নিজের দেশের বুর্জোয়াদের মোকাবিলা করতে হয়। আজও তা সঠিক, কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি দেশের শ্রমজীবী জনগণের দেশীয় শাসকশ্রেণির মোকাবিলার সংগ্রাম আজকের অনেক বেশি পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের ভারসাম্য বদলের সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। সে কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কৃষকদের সংগ্রাম থেকে শক্তি ও দিশা সংগ্রহ করেছে ইউরোপের কৃষকরা, আবার পৃথিবীব্যাপী চলা শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের সঙ্গে ভারতের শ্রমজীবীদের সংগ্রাম সরাসরি যুক্ত হতে পারছে। শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতির সম্ভবনার ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়েছে।
নয়া উদারবাদের তিন দশক ভারতের পুঁজিবাদকে গুণগতভাবে পরিবর্তন করে চলেছে। এখানে গোদের ওপর বিষফোঁড়া সামন্ততন্ত্রের শক্তিশালী অবশেষ। সেখানেও গুণগত পবির্তনের সম্ভাবনা। ভারতের কৃষিতেও পুঁজির অনুপ্রবেশ এখন কার্যত কর্পোরেট লুটের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। ফলে ভারতেও শ্রেণিগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন সম্ভাবনায় উপস্থিত হবার সম্ভাবনা তৈরি করছে। সাম্প্রতিক কৃষক সংগ্রাম ভারতীয় শাসকশ্রেণির মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব উপস্থিত করেছে। শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে থাকলেও পৃথিবীতে চারটি মৌলিক বিশ্ব সামাজিক দ্বন্দ্ব এখনও অব্যাহত এবং তা বিভিন্ন মাত্রায় তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের পথ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে, শ্রমিক-কৃষক দৃঢ় মৈত্রীর ভিত্তিতে কৃষি বিপ্লবের অক্ষপথে অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এদেশের কমিউনিস্টদের কর্তব্য। দিকচক্রবালে এর কি কোনও সুস্পষ্ট সম্ভাবনা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি? উত্তর না। তবে কি এটা অলীক? তারও উত্তর— না। এখানে আমরা সহজেই লেনিন থেকে কথা ধার করতে পারি—  বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব সম্মত বিশ্লেষণ হলো দ্বান্দ্বিকতার মর্মবস্তু। দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বা অবস্থা মানে একই সঙ্গে পরস্পর বিপরীত গুণ বা উপাদানের উপস্থিতি ও সংঘাত। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পৃথিবীতে শ্রমজীবীদের শ্রেণিসংগ্রাম থাকবেই। আজকের সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে ভারসাম্য শ্রমজীবীদের অনুকূলে পরিবর্তন করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন আসে শ্রমজীবীদের বিজয়েরও তো পরিবর্তন হতে পারে। হ্যাঁ পারে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে নেতির নেতিকরণ না ঘটলে প্রতিবিপ্লব হতে পারে, আর ঘটলে মানব সমাজ শোষণ ও শ্রেণি ব্যবস্থা থেকে উন্নততর ব্যবস্থার দিকে এগতে পারে।

ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব 
ভারতে যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ নির্দিষ্ট হয়েছে তা কার্যকর করা অনেকগুলি শর্তের ওপর নির্ভরশীল। বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি না হলে বিপ্লব অসম্ভব, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। আবার বিপ্লবী পরিস্থিতি এলেই বিপ্লব হয় না, বিপ্লবীদের বিষয়ীগত প্রস্তুতি রাখতে হয়। ভারতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতিকে কার্যকর করার রণকৌশলটি হলো বামগণতান্ত্রিক জোট গঠন। জনগণতান্ত্রিক জোট আর বামগণতান্ত্রিক জোটের শ্রেণি সম্পর্কের মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে, মৌলিক পার্থক্য হলো জনগণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণির হাতে থাকতেই হবে। আর বামগণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণির হাতে নাও থাকতে পারে। বিশেষত ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে তো নয়ই। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে কৃষক ও গ্রামীণ সর্বহারাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ের কৃষক আন্দোলন, শ্রমিকশ্রেণির বিভিন্ন আন্দোলন, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলির আন্দোলন আজকে ভারতে যে বামগণতান্ত্রিক জোট গঠনের সম্ভাবনার সৃষ্টি করছে, ক’বছর আগেও কি তা ছিল? ভারতীয় বিপ্লবীদের এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই বামগণতান্ত্রিক জোট কোনও নির্বাচনী ফ্রন্ট নয়, শ্রেণি ও গণসংগ্রামের ফলিত রূপ হতে হবে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে শ্রেণিভারসাম্যের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও গত কয়েক মাস পশ্চিমবাংলায় শ্রমজীবী অংশের স্বার্থবাহী রাজনীতির এক সম্ভাবনার রূপোলি রেখা দেখা যাচ্ছে। আমরা যদি মনে করি শুধুমাত্র দুর্নীতি দেখে এ রাজ্যের মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের মানসিকতা তৈরি হচ্ছে তাহলে পরিস্থিতির জটিলতা ও সম্ভাবনার অতিসরল মূল্যায়ন করা হবে। কোনও সন্দেহ নেই মিডিয়াতে কোটি কোটি নগদ টাকার পাহাড় রাজবাসীর সম্বিত ফেরাতে সাহায্য করছে। এটা একটা প্রধান কারণ তবে এর পিছনে রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্কট এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রতারণার অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিপুল সংখ্যায় যুবজনঅংশের সঙ্কট, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ক্রোধ আজকে এরাজ্যে শ্রেণি ভারসাম্য বদলের সংগ্রামে শক্তি বৃদ্ধি করছে। শ্রমিকশ্রেণির সংগঠিত বাহিনী কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা তাকে গতি দিতে পারে।  বলা যায় আজকের বাংলার যুবজনঅংশ যারা শ্রমজীবীদের অংশভুক্ত এবং শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, কর্মচারী সহ সমস্ত সাধারণ মানুষ নতুন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করছে। সচেতন না থাকলে এখানেও অতিসরলীকরণের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। প্রতিকূলতার মাঝে শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা কি সরাসরি সমাজ পরিবর্তনের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে? কখনোই না। তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশব্যাপী বামগণতান্ত্রিক জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক উপাদান সৃষ্টি করবে। তাই ছোট-মাঝারি আন্দোলনগুলিকে মূল শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যুবজনঅংশের মধ্যে আরএসএস/বিজেপি/তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্যকে অতিক্রম করে নবউদ্যমে বামপন্থার প্রতি যে আকর্ষণ বাড়ছে তাকে শ্রমজীবীদের শ্রেণিসংগ্রাম ও নিপীড়িত জনঅংশের বঞ্চনা বিরোধী আন্দোলনের অভিমুখী করতে হবেই। এই দায়িত্ব বিপ্লবীদের। প্রকৃত বিপ্লবীদের সব সময়েই বর্তমানের সংগ্রামের মধ্যে ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব গড়ে তুলতে সচেতন ও সক্রিয় থাকতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment