Mridul Dey

প্রয়াত কমরেড মৃদুল দে

রাজ্য

Mridul Dey


সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটি ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর প্রাক্তন সদস্য কমরেড মৃদুল দে’র জীবনাবসান হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে এগারোটায় রাজারহাটের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওই হাসপাতালেই তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল। জানুয়ারি মাস থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬। 
সোমবার রাতে তাঁর মরদেহ রেখে দেওয়া হয়েছে। সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন তাঁর শেষকৃত্যের কর্মসূচি মঙ্গলবার সকালে ঘোষিত হবে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। 



স্বাধীনতার ঠিক আগে অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামে কমরেড মৃদুল দে’র জন্ম। ১৯৪৭ সালের ৯ জুন তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কমিউনিস্ট নেতা ডা. যোগেশ চন্দ্র দে। স্কুলের পঠনপাঠন শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক স্নাতক হন মৃদুল দে। এরপরে ১৯৬৮ সালে তিনি শিলিগুড়িতে গিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পড়তে ভর্তি হন। তখনই তিনি ছাত্র আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। সেই সময়ে শিলিগুড়িতে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে ছাত্রদের পরামর্শ দিতেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিভিন্ন লিফলেট লেখা, দেওয়াল লেখা, পোস্টার লেখা ইত্যাদি নিয়েও পরামর্শ দিতেন তিনি।

ছয়ের দশকের শেষে এবং সাতের দশকের শুরুতে শিলিগুড়িতে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া কমরেড মৃদুল দে কংগ্রেস ও সিপিআই (এম) বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াইতে সামনের সারিতে থাকতেন। এমনকি শারীরিক আক্রমণ প্রতিরোধেও প্রথম সারিতে থাকতেন। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়ে একদিন রাতে শিলিগুড়িতে সিপিআই(এম)’র পুরনো পার্টি দপ্তরে ছিলেন তিনি। সেই সময়ে পুলিশ পার্টি দপ্তরে হানা দিয়ে গ্রেপ্তার করে তাঁকে। প্রায় একমাস জেলে ছিলেন। তখন তাঁর পদার্থবিদ্যার পড়াশোনার নোট দেখিয়ে পুলিশ বলেছিল যে এগুলো সব ‘বোমা বানানোর ফর্মুলা’। পরে অবশ্য তাঁর জামিন হয়ে যায়। এর আগে ১৯৬৯ সালে শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বিপিএসএফ’এর ১৯তম রাজ্য সম্মেলন। সেই সম্মেলন সফল করতেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিলিগুড়িতে সেই সময়ে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের বহু নেতা কর্মী প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন মৃদুল দে’র মাধ্যমে। সাতের দশকে শিলিগুড়িতে মৃদুল দে’র একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিলো কষ্টসহিষ্ণু এবং সাহসী হিসাবে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে দৃঢ়তার পাশাপাশি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাঁর উন্নত চেতনা ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শে দৃঢ় থেকে নকশালপন্থী ও সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন তিনি। কংগ্রেস ও ছাত্র পরিষদের রাজনৈতিক ও শারীরিক আক্রমণের বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়েছেন। একবার শিলিগুড়িতে পার্টি দপ্তরে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারের উপস্থিতিতে সভা চলাকালীন নকশালপন্থীরা পার্টি দপ্তরে আক্রমণ করে। সেই সময়েও প্রতিরোধ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

শিলিগুড়িতে থাকাকালীন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষার প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা চলাকালীন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মৃদুল দে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর মৃদুল দে কলকাতায় চলে আসেন এবং সিপিআই(এম)’র সর্বক্ষণের কর্মী হন। এই সময়েই তিনি গণশক্তি পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত হন। সাংবাদিক হিসাবে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, পরে দেশে এবং বিদেশেও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ কভার করার কাজ করেছেন তিনি। গণশক্তি পত্রিকায় দীর্ঘদিন তিনি মুখ্য সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আটের দশকের শেষে ও নয়ের দশকের গোড়ায় পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবহুল পর্বে, সোভিয়েতের বিপর্যয়ের সময়ে তিনি সেখান থেকে সংবাদ প্রেরণ করেছেন গণশক্তির জন্য, যা বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। গণশক্তি পত্রিকার প্রভাতী সংস্করণ প্রকাশে, পত্রিকার উন্নয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। পরে, পার্টির অন্য সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হলেও গণশক্তির নিয়মিত লেখক ছিলেন। 

১৯৮৫সালে কমরেড মৃদুল দে সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালে তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে পার্টির কোয়েম্বাটুর কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ স্মৃতি পুরস্কার কমিটির সভাপতি হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। গণআন্দোলনের পাশাপাশি প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা রাজনৈতিক বহু বই ও পুস্তিকা রয়েছে। 
কমরেড মৃদুল দে’র স্ত্রী ও এক পুত্র রয়েছেন।


 

Comments :0

Login to leave a comment