Dalit murdered in UP

বাইকে কেন! উত্তর প্রদেশে পিটিয়ে হত্যা দলিত যুবককে

জাতীয়

 মধ্য প্রদেশে পুলিশ লকআপে এক দলিত যুবককে হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যেই উত্তর প্রদেশে এক দলিত যুবককে রাস্তায় পিটিয়ে খুন করা হলো। মঙ্গলবার বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশের মুজফ্‌ফরনগরের পালদি গ্রামের রাস্তায় ২০ বছরের দ‍‌লিত যুবক সানি ও তাঁর আত্মীয় শিলুর উপর আক্রমণ চালায় ওই গ্রামেরই প্রধানের ছেলে ও তার দলবল। নিম্নবর্ণের এক জন হয়ে উচ্চবর্ণের সামনে দিয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁর ‘অপরাধ’। তাদের বেধড়ক মারে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সানির, গুরুতর আহত হন শিলু। এর আগে গত শনিবার মধ্য প্রদেশের দেবাসের সাতবাস থানার মধ্যে ৩৫ বছরের দলিত যুবক মুকেশ লঙরেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, গলায় কাপড় লাগানো অবস্থায় তাঁর দেহ ঝুলছিল থানার লকআপের জানালা থেকে। পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে থানায় পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে এবং তা একরক‍‌ম স্বীকার করে নিয়ে মধ্য প্রদেশ সরকার সাতবাস থানার ইন্সপেক্টর আশিস রাজপুতকে সাসপেন্ড করতে ও ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছে। 
মুজফ্‌ফরনগরের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, গ্রামের রাস্তায় বাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন সানি, সঙ্গে ছিলেন শিলু। সেই সময়ে একই রাস্তায় গাড়িতে যাচ্ছিল পালদি গ্রামের প্রধানের ছেলে। সানির বাইকের পথ আটকে সে ঝগড়া শুরু করে সানির সঙ্গে। তারপর গাড়ি থেকে লাঠি বের করে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে সানি ও শিলুকে। গ্রামপ্রধানের ছেলের কিছু সঙ্গীও তাতে যোগ দেয়। লাঠির বারিতে মৃত্যু হয় সানির, গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি শিলু। গ্রামপ্রধানের ছেলেকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও ঘটনায় যুক্ত সন্দেহে কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুজফ্‌ফরনগরের পুলিশ সুপার (সিটি) সত্যনারায়ণ প্রজাপতি। অন্যদিকে, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, গ্রামের রাস্তায় তার গাড়ির পাশে এক দলিত যুবকের বাইক চালিয়ে যাওয়া মানতে না পেরেই গ্রামপ্রধানের ছেলে আক্রমণ করে সানিকে। প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে রাজস্থানে এক দলিত যুবক ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যা‍‌চ্ছিলেন বলে তাঁকে ও তাঁর বাবাকে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করেছিল উচ্চবর্ণের লোকরা। দলিত যুবক কেন ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবে, ওটা শুধু উচ্চবর্ণের অধিকার— এই ছিল হত্যাকারীদের অবস্থান। সেই মনোভাব এখনও প্রবলভাবেই বিদ্যমান ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে উচ্চবর্ণের অনেকের মধ্যে। 
বাস্তবে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশের নানা জায়গায়, বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তফসিলি জাতি, অদিবাসী ও দলিতদের উপর আক্রমণ ও অত্যাচার বেড়েছে। কেন্দ্রের ন্যাশনাল ক্রাইমস রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) ২০২২ সালের রিপোর্টেই তা সামনে এসেছিল। কেন্দ্রের এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য আরও জানিয়েছে, নিম্নবর্ণের উপর অত্যাচারে সবথেকে বেশি এগিয়ে আছে বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশ। তার পিছনে পরপর রয়েছে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ ও বিহার। সবকটিই বিজেপি-শাসিত রাজ্য। এর মধ্যে শুধু বিহারে বিজেপি ক্ষমতায় আছে জেডি(ইউ)’র সঙ্গে জোট গড়ে। এনসিআরবি’র ওই রিপোর্ট আরও জানিয়েছিল, শুধু ২০২২ সালে নিম্নবর্ণের উপর আক্রমণের যত ঘটনা পুলিশে নথিভুক্ত হয়েছে, তার ৯৭.৭ শতাংশই ঘটেছে দেশের ১৩টি রাজ্যে। সেগুলির মধ্যে উত্তর প্রদেশে ২৩.৭৮ শতাংশ, রাজস্থানে ১৬.৭৫ শতাংশ এবং মধ্য প্রদেশে ১৪.৯৭ শতাংশ ঘটেছে। চিত্র বদলায়নি ২০২৩ বা ২০২৪ সালেও। তথ্য বলছে, সারা শরীরে নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর অত্যাচারের একরাশ ক্ষতচিহ্ন নিয়েই বিদায় নিল ২০২৪। বছরের প্রথম মাসেই রাজস্থানের আজমেঢ়ে ১৭ বছরের এক নাবালক উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বর্বর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। দিনটি ছিল ২৬ জানুয়ারি, দেশের নাগরিক হিসাবে সবার সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৫০ সালের যে দিনটিতে ভারতে চালু হয়েছিল নিজস্ব সংবিধান এবং ভারত তার যাত্রা শুরু করেছিল সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পথে। ওই দিন আজমেঢ়ের আনা সাগর চৌপথীতে ১৭ বছরের এক দলিত ছাত্র রিল বানানোর জন্য ভিডিও তুলছিল। রাস্তায় তা করাও দলিতদের পক্ষে অপরাধ বলে মনে করেছিল উচ্চবর্ণের পুষ্পেন্দ্র, রোহিত ও গোকুল। তারা দশম শ্রেণির ওই ছাত্রকে নৃশংসভাবে লাঠি দিয়ে পেটায়, মুখে প্রস্রাব করে দেয়, সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় ও তার মুখে মদ ঢেলে গিলতে বাধ্য করে। 
তফসিলি জাতি, আদিবাসী ও দলিতদের উপর ক্রমবর্ধমান এই আক্রমণের জন্য বিজেপি’র মনুবাদী রাজনৈতিক দর্শনকেই দায়ী করেছেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। মঙ্গলবার বছরের শেষ দিনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্স-এ তিনি পরপর এমন আক্রমণের তথ্য উল্লেখ করে লিখেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে দাঁড়িয়ে ড. আম্বেদকরকে অপমান করেছেন, আর আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বঞ্চিতদের বিরুদ্ধে সেই একই মানসিকতার বারবার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিজে‍‌পি-শাসিত রাজ্যগুলিতে। যাঁরা গরিব ও বঞ্চিত, তাঁদের উপর মনুবাদের নিষ্পেষণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। দেশে প্রতি ঘণ্টায় কোথাও না কোথাও দলিত-আদিবাসী মহিলা ও শিশুর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এনসিআরবি’র তথ্য অনুসারে, ২০১৪’র তুলনায় এমন আক্রমণের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। আরএসএস-বিজেপি’র এই দর্শন ও সংবিধান-বিরোধী ভাবনার বিরুদ্ধে কংগ্রেস লড়াই চালিয়ে যাবে। সোমবারই মধ্য প্রদেশের সাতবাসে পুলিশি হেপাজতে দলিত যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীও বলেছিলেন, দলিতদের অধিকার এবং সুবিচারের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাবে তাঁদের দল। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে দলিত, আদিবাসী সহ নিম্নবর্ণের উপর একের পর এক নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছিলেন, বিজেপি’র মনুবাদী ভাবনা-চিন্তার কারণেই এই ধরনের অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয় ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। রাজ্য সরকারের মদত ছাড়া এই ধরনের ঘটনা সম্ভব না। কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও নিম্নবর্ণের উপর জাতপাতের এমন অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সমাজের দুর্বলতর অংশের ওপর নিষ্পেষণ চালানোর মধ্য দিয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকরকেই অবজ্ঞা করা হচ্ছে। এটাই বিজেপি-শাসনের মূল মন্ত্র।            

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment