West Bengal Recruitment Scam

কালীঘাটের কাকুর সুপারিশেই তৃণমূলের প্রার্থী হন মানিক, দাবি ইডি’র

রাজ্য

West Bengal Recruitment Scam

সুদীপ্ত বসু: কলকাতা,

এ যেন বাস্তবিকই ‘মানিক জোড়’!
শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ধৃত সুজয় ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু ও তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে দুর্নীতির কারবার চালিয়েছিলেন দীর্ঘদিন ধরে।
শুধু তাই নয়, দুর্নীতিতে ‘ভালো পারফরমেন্স’ই যে মানিক ভট্টাচার্যকে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের তৃণমূলের টিকিট পেতে সাহায্য করছিল, তাও সামনে এসেছে ইডি’র দাখিল করা চার্জশিটের তথ্যেই।
গত ২৮ তারিখে আদালতে জমা দেওয়া অতিরিক্ত চার্জশিটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি একাধিক তথ্য, প্রমাণ হাজির করেই দাবি করেছে যে অভিষেক ব্যানার্জির ‘বার্তাবাহক’ কালীঘাটের কাকুর সঙ্গে মানিক ভট্টাচার্যের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একে অপরের প্রতি ‘কৃতজ্ঞ’ ছিল। সেই কৃতজ্ঞতা কেন? কেন এই দুর্নীতির শৃঙ্খলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন?
ধৃত কালীঘাটের কাকু ও মানিক ভট্টাচার্যকে জেরার পাশাপাশি তদন্তে আরো একাধিক ব্যক্তিকে জেরা করেই সামনে এসেছে সেই তথ্য।


চার্জশিটে ইডি দাবি করেছে কালীঘাটের কাকু মানিক ভট্টচার্যের অফিসে যেতেন অভিষেক ব্যানার্জির বার্তা পৌঁছে দিতে। কালীঘাটের কাকুই মানিক ভট্টাচার্যের কাছে অবৈধ ভাবে টেট পাশ করিয়ে দেওয়ার সুপারিশ সহ তালিকা পাঠাতেন। হোয়াটসঅ্যাপেও সেই নথি মানিক ভট্টাচার্যকে দিতেন তিনি। এজেন্ট হিসাবে রাজ্যে যুব তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বনে যাওয়া কুন্তল ঘোষ যে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন, সেই তালিকা ভায়া কালীঘাটের কাকু পৌঁছে যেত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির কাছে। কিন্তু মানিক ভট্টচার্যের সঙ্গে কালীঘাটের কাকুর ঘনিষ্ঠতার রহস্য কী ছিল?
চার্জশিটে ইডি’র দাবি, ‘সুজয় ভদ্রই মানিক ভট্টাচার্যকে এমনকি বিধানসভায় তৃণমূলের টিকিট পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন’! অর্থাৎ অভিষেক ঘনিষ্ঠ সুজয় ভদ্র শাসক তৃণমূলের প্রভাবশালী মহলের এতটাই কাছের ছিলেন মানিক ভট্টাচার্য তাঁকে ধরছিলেন তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য। কালীঘাটের কাকুই দলের প্রভাবশালী মহলের কাছে মানিক ভট্টাচার্যকে বিধানসভা ভোটের টিকিট পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন।


মমতা ব্যানার্জির সরকার আসার পরেই তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি পদে বসানো হয়। তাঁরপর তিনবার শিক্ষা মন্ত্রী বদল হয়েছে, মানিক ভট্টাচার্যের বদল হয়নি। ২০১২ থেকে ২০২২, দশ বছর তিনি একই পদে ছিলেন। এহেন কীর্তিমান মানিক ২০১১ সালে তৃণমূলের হয়ে পলাশীপাড়া থেকে বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সিপিআই(এম) নেতা এসএম সাদির কাছে ভোটে পরাজিত হন। এরপর ২০১৬ সালের ভোটে আর টিকিট পাননি। ততক্ষণে ২০১২-১৪’র টেট নিয়ে দুর্নীতি ডালপালা ছড়িয়েছে। মধ্যমণি মানিক ভট্টাচার্য। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি হয়ে নিজেই টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের পাশ করিয়ে দেওয়ার কারবারে সরাসরি যুক্ত। বিপুল সম্পত্তি বানিয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতির টাকায়। ছেলের সংস্থাও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। যদিও ২০১৬ সালে বিধানসভায় টিকিট না পাওয়ায় একটু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।


ততক্ষণে কালীঘাটের কাকুর সঙ্গে সখ্য বেড়েছে। অভিষেক ব্যানার্জির অফিসের লোক সুজয় ভদ্র- ফলে ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে। কালীঘাটের কাকুর একের পর এক সুপারিশের তালিকা জমা পড়ে মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। টাকার লেনদেন চলে। শান্তনু ব্যানার্জি, কুন্তল ঘোষের মতো এজেন্টরা একেবারে দলীয় পরিকাঠামো ব্যবহার করে টাকা তুলতে শুরু কর। জেলায় জেলায় এজেন্ট চক্র।তৈরি হয়ে মেধা তালিকার পালটা তালিকা। টাকার বিনিময়ে টেট পাশ থেকে শুরু করে চাকরি পাইয়ে দেওয়া- একেকটার একেকরকম রেট। কুন্তল  ঘোষ, শান্তনু ব্যানার্জি থেকে তালিকা আসতো কালীঘাটের কাকুর কাছেও। এরপর সেই  তালিকা সুপারিশ সহ কালীঘাটের কাকু পৌঁছে দিতেন মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। চার্জশিটে স্পষ্ট দাবি, অভিষেকের বার্তাবাহক হয়েই মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে যেতেন সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু।
আর খোদ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি হয়ে সমস্ত অবৈধ তালিকা ধরে পাশ করিয়েো দেওয়া, চাকরির গ্যারান্টি দেওয়ার ফলশ্রুতিতেই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ২০২১’র বিধানসভা ভোটে ফের মানিক ভট্টাচার্যকে টিকিট পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন।


চার্জশিটে ইডি’ বলেছে- ‘এটাও উল্লেখ করতে হচ্ছে যে সুজয় ভদ্রও কিন্তু মানিক ভট্টাচার্যকে সাহায্য করেছিলেন, মানিক ভট্টাচার্যকে তৃণমূলের টিকিট পাইয়ে দিতে সুপারিশ করেছিলেন। ফলে এটা স্পষ্ট যে তাঁরা দু’জন যে দুজনের জন্যই’।
অভিষেকের বার্তাবাহক হিসাবে কালীঘাটের কাকুর ২০১৪’র টেটের একের পর এক সুপারিশ, তালিকা মেনে অবৈধ নিয়োগ চালিয়েছিলেন মানিক ভট্টাচার্য- বিনিময়ে মিলেছিল কাকুর সুপারিশে ২০২১ সালে পলাশীপাড়া থেকে তৃণমূলের টিকিট। ৯ মাসের বেশি সময় ধরে নিয়োগকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে মানিক ভট্টাচার্য। যদিও তাঁকে বিধায়ক পদ থেকে এখনও সরাননি মমতা ব্যানার্জি।
শুধু তাই চার্জশিটে ইডি’র দাবি, তদন্তকারী সংস্থার জেরার মুখে সুজয় ভদ্র নিজের বয়ানে জানিয়েছেন যে, কালীঘাটের তৃণমূলের অফিসে বসার সুবাদে প্রচুর সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী তাঁর কাছে আসতেন চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আরজি নিয়ে। কালীঘাটের তৃণমূলের অফিস থেকেও যে এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির অপারেশন চলেছিল তাও স্পষ্ট খোদ কালীঘাটের কাকুর বয়ানেই।



 

Comments :0

Login to leave a comment