লোকসভা নির্বাচনের আগে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্তত দু’টি দিক থেকে এই নির্বাচনী ফলাফলকে দেখাই যেতে পারে। একদিকে, এই জয় বিজেপি’র উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারে আরও গতি বাড়াবে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে চরম জায়গায় নিয়ে যেতে চাইবে। অন্যদিকে, দেশরক্ষার তাগিদ, দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যাবে, জীবন-জীবিকার লড়াইকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বিরোধী শিবিরকে।
রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়— হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য এতটা ‘ভালোরকম’ জয়, সম্ভবত আরএসএস’কেও বিস্মিত করে থাকবে। বুথ ফেরত সব সমীক্ষাকেও হতাশ করে দিয়েছে এই ফলাফল। বিশেষ করে ছত্তিশগড়ের কুর্সি কংগ্রেসের থেকে বিজেপি’র ছিনিয়ে নেওয়া। ব্যতিক্রম অবশ্য দক্ষিণের তেলেঙ্গানা, যার দখল নিয়েছে কংগ্রেস। দক্ষিণ ভারতের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে ওখানে বিজেপি’র কোনও রাজনৈতিক প্রভাব নেই। তাসত্ত্বেও ঘাড়ের কাছে যখন লোকসভা নির্বাচন, তখন এই ভোটের ফল গেরুয়া শিবিরকে বাড়তি হাওয়া জোগাতে পারে। যদিও একথা বলাই যেতে পারে, বিধানসভার নির্বাচন সবসময় লোকসভার নির্বাচনে নির্ণায়ক হয়ে ওঠে না। ২০১৮ সালেই রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে বিধানসভায় বেশ খারাপ ফল করেও পুলওয়ামার ঘটনাকে হাতিয়ার করে শেষ পর্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে এই তিন রাজ্যে লোকসভায় প্রায় সব আসন তুলে নিয়েছিল বিজেপি।
শেষ পর্যন্ত উগ্র হিন্দুত্বের প্রচারেই কি বাজিমাত করল বিজেপি? কী কারণে কংগ্রেসের এমন ফল হলো, কিংবা বিজেপি কোন জাদুবলে এই ফল করল, তার আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন আছে, এবং তা হবেও। কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট, বেকারত্ব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, গণতন্ত্র হরণের মতো দেশের জ্বলন্ত সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। অতএব নতুন বছরের গোড়ায় রামমন্দির ‘উদ্ঘাটনকে’ কেন্দ্র করে গেরুয়া শিবির যে হিন্দুত্বের প্রচারে ঝড় তুলতে চাইবে তা বলাই বাহুল্য। তার শুরুয়াতও ভোটের ফল প্রকাশের পরই শুরু করে দিয়েছে বিজেপি, সঙ্গী ‘গোদি মিডিয়া’। জাতভিত্তিক গণনাকে খারিজ করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে অমিত শাহের কথার মূল সুর ছিল এটাই। একই সঙ্গে মোদী ভজনাও সর্বোচ্চ মাত্রায় শুরু করা হয়েছে। কর্নাটকের ভোটে সর্বশক্তি নিয়োগ করার পরেও ভরাডুবির পর বিজেপি মুষড়ে পড়েছিল, একইভাবে মোদীর ভাবমূর্তিও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এই জয়কে ফের মোদীর জয় হিসাবে দেখাতেই ব্যস্ত তারা, মোদীময় প্রচারই ভবিষ্যতের পথ বুঝিয়ে দিয়েছে বিজেপি।
চ্যালেঞ্জটা ঠিক এখানেই। আর তাই ভোটের ফল বেরুনোর পরে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কিছুটা সতর্ক করে দিয়েই বলেছেন, ‘জনগণের জীবন-জীবিকা এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চরিত্র সুরক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দ্বিগুণ উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ কিংবা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মতাদর্শগত লড়াই জারি থাকবে।’ বস্তুত, এই চার রাজ্যের ফল আগামী লোকসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে তা ভবিষ্যৎই বলবে। এবং তা নির্ধারিত হবে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই কতটা জোরালো হবে তার ওপর। প্রাথমিক বিবৃতিতে লোকসভা ভোটের আগে চার রাজ্যের ফলাফলকে ‘সাময়িক ধাক্কা’ বলেই মনে করছেন বিরোধী নেতারা। ফলে সেই বিপর্যয় কাটিয়ে নতুন উদ্যমে লড়াইয়ের লক্ষ্য নিয়েই বৈঠকে বসতে চলেছেন ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। এই ফলাফল একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, উগ্র হিন্দুত্বের প্রশ্নে কোনও নরম মনোভাব নিয়ে লড়াই চালানো যায় না। আরএসএস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই চালাতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে, এবং তা করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গেই। বিজেপি আরএসএস’র প্রতি দুর্বল মনোভাব কিংবা আপসের আভাস যারা দিয়ে রেখেছে, তৃণমূলের মতো সেইসব দলের পক্ষে, এখন মুখে যে কথাই বলুক না কেন, শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই তারা দিতে পারে না। একমাত্র রাজ্যগত পরিস্থিতির বস্তবতা এবং বিন্যাস বুঝেই ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াই আরও জোরদার হতে পারে।
Comments :0