Editorial

মোদীর মুশকিল আসান সিবিআই

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial CBI for Odisha train accident


সকাল বেলায় রেলমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন দুর্ঘটনার কারণ জানা গেছে এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদেরও চিহ্নিত করা গেছে। রেল নিরাপত্তা কমিশনের তরফে তখনো কোনও রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। ইত্যবসরে রেলেরই শীর্ষস্তরের নানা সূত্রে পরিষ্কার হয়ে গেছে বালেশ্বরের কাছে দুর্ঘটনাস্থলে সিগনালের সঙ্গে লাইনের পয়েন্টের অমিল ছিল। অর্থাৎ সিগনাল সবুজ হলেও পয়েন্ট খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে। করমণ্ডল এক্সপ্রেস যাচ্ছিল মেইন লাইন ধরে। করমণ্ডলের আগে সেই মেইল লাইন ধরে যাচ্ছিল লৌহ আকরিক বোঝাই মালগাড়ি। করমণ্ডলকে রাস্তা ছেড়ে দেবার জন্য পয়েন্টের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হ‌য় লুপ লাইনের দিকে। সেই মতো মালগাড়ি মেইন লাইন থেকে ঢুকে যায় লুপ লাইনে। খালি হয়ে যায় মেইন লাইন। এরপর মেইন লাইনে করমণ্ডলকে যাবার জন্য প‍‌য়েন্টের লুপ লাইন বন্ধ হয়ে মেইন লাইনের মুখ খুলে যাবার কথা এবং একই সঙ্গে মেইন লাইনের সিগনাল সবুজ হবার কথা।

 কার্যক্ষেত্রে সিগনাল সবুজ হলেও মেইন লাইনের দিকে পয়েন্টের মুখ খোলেনি। সেটা খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে। ফলে করমণ্ডল লুপ লাইনে ঢুকে প্রবল বেগে ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির পেছনে।
স্বয়ংক্রিয় যে সিগনালিং ব্যবস্থা তাতে এমনটা হবার কথা নয়। পয়েন্টের মুখ যে লাইনের দিকে খোলা হবে সিগনাল হবে সেই লাইনেই। এক্ষেত্রে পয়েন্ট খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে অথচ সিগনাল হলো মেইন লাইনে। তারই অনিবার্য পরিণতি প্রায় তিনশ মানুষের মৃত্যু ও সহস্রাধিক আহত। বোঝাই যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় সিগনালিং ব্যবস্থাতেই গোলযোগ। রেল সূত্রেও এমনটাই জানা গেছে। এরপর সেদিন বিকেলেই রেলমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন রেল বোর্ড সিবিআই তদন্ত চেয়েছে অর্থাৎ তদন্ত করবে সিবিআই। রেলের বিভাগীয় তদন্ত, জিআরপি’র তদন্ত, সর্বোপরি রেল নিরাপত্তা কমিশনের তদন্ত শেষ হবার মুখে আচমকা নামিয়ে দেওয়া হলো সিবিআইকে।


সিবিআই’র কাজ ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করা। রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করার মত যান্ত্রিক, প্রযুক্তিগত ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ তাদের নেই। তাই সিবিআই’র তদন্তের কথা শুনে সব মহলই বিষ্ময়ে হতবাক। বিষয়টা অনেকটা অনধিকার চর্চার মতোই। প্রশ্ন ওঠে তবে কি সরকার আসল সত্য ধামাচাপা দিতে সিবিআই-কে ব্যবহার করছে? উচ্চমানের প্রযুক্তির অভ্যন্তরীণ জটিলতার রহস্য ভেদ সিবিআই’র কাজ নয়। তবে কি সমস্যার মূল থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সরকারের ক্ষমাহীন পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতাকে আড়াল করার সচেতন প্রয়াস। বিরোধীরা সেই দিকেই আঙুল তুলেছেন।
মাত্র চার মাস আগে কর্নাটকের মাইসুর ডিভিসনে এমনই এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবার পর দক্ষিণ-পশ্চিম রেলের মুখ্য অপারেশন ম্যানেজার ঐ জোনের জেনারেল ম্যানেজারকে লিখিতভাবে সিগনালিং ব্যবস্থার দুরবস্থার কথা জানিয়ে সতর্ক করেছিলেন গোটা সিগনালিং ব্যবস্থার নি‍‌য়মিত নজরদারি, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন না করলে বিপদের আশঙ্কা বাড়তেই থাকবে। বোঝাই যাচ্ছে সেই সতর্কতা রেলের শীর্ষ কর্তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। তাই নিরাপত্তার প্রশ্নটি অবহেলিতই থেকে যায়। যাত্রীদের প্রাণ হাতে নিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। চার মাস আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে বালেশ্বরে। মাইসুরুতে রক্ষা পেলেও এখানে রক্ষা পায়নি।
গত বছর জাতীয় অডিট সংস্থা সিএজি তাদের রিপোর্টে বলেছে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ সালের মধ্যে যে ২০১৭টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে তার ৬৯ শতাংশই লাইনচ্যুতির ফলে। আর ১১২৯টি তদন্ত রিপোর্টে এই লাইনচ্যুতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভুল পয়েন্ট এবং সিগনালিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত ঘাটতি। সেই রিপোর্টও কোনও গুরুত্ব পায়নি মোদী সরকারের কাছে। সিএ‍‌জি রিপোর্ট থেকে আর একটি গুরুতর তথ্য মেলে। বিগত বছরগুলিতে দুর্ঘটনার সংখ্যা সামান্য কমলেও শেষ মুহূর্তে দুর্ঘটনা এড়ানোর ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। অর্থাৎ যাত্রীদের জীবনের অনিশ্চয়তা বেড়েছে।
করমণ্ডলের দুর্ঘটনা প্রমাণ করেছে মোদী সরকারের কাছে নিরাপত্তা গুরুত্বহীন। পুরানো ঝরঝরে লাইনে চলছে বেশি গতির ট্রেন। লাইন সংস্কার না করে মোদীর প্রচারের জন্য ১৮০ কিমি গতির বন্দে ভারত চলছে ৮০ কিমি গতিতে। রেল পরিকাঠামোর প্রতিটি প্রকোষ্ঠেই অবহেলা, ব্যর্থতা আর বিপদের ছবি। এই সবটা মানুষের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় সব চাপা দিতে নামানো হ‍‌য়েছে সিবিআই।


 

Comments :0

Login to leave a comment