মুক্তধারা
বই
নারীদের এগিয়ে চলার কাহিনী
সুবিনয় মিশ্র
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারীরা আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশেও রয়েছে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। একটা সময়ে নারীরা ছিলেন গৃহবন্দি। সেই বন্দিদশা ঘুচিয়ে তাঁদের অতিক্রম করতে হয়েছে নানা সামাজিক বাধা। সব বাধা আজও মুক্ত হয়নি। তাই বলে তাঁরা বসে থাকেননি। দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণআন্দোলনেও দেখা গেছে তাঁদের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায়। আলোচ্য বইটিতে খ্রিস্টীয় ১২ শতক থেকে শুরু করে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভারতের প্রায় সকল অঞ্চল ও জীবনের প্রায় সমস্ত শীর্ষ থেকে আহৃত ৪৭ জন অসামান্য নারীর অলোকিত জীবনকে সহজভাবে তুলে ধরা হয়েছে নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের কাঠামোয়। এর আগে নারীদের জীবনকথা নিয়ে নানা ধরনের জীবনীমূলক অভিধান বেরিয়েছে। শ্যামলী গুপ্তের বঙ্গ মহিলা চরিতাভিধান, জীবন রায়ের নারী অভিধান, ছাড়াও বিজ্ঞানীদের চরিতাভিধান, জাতীয় চরিতাভিধান, স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান, গ্রন্থাগারিক চরিতাভিধানের মতো বহু জীবনীমূলক অভিধান বেরিয়েছে। তবে এই বইটি ৪৭জন নারীর যে জীবনী তুলে ধরেছে তার মাহাত্ম্য আলাদা।
এমনিতেই মতাদর্শ ভিত্তিক আন্দোলনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেকে ক্রিয়াশীল রাখা কঠিন কাজ। তার উপর নারীদের সেই কাজটা করতে হয় বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করে। উপেক্ষা করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একপেশে নিয়মকানুনের একাধিক চাপও। এমনকি, লিঙ্গ-বিভাজনের ইতিহাস নারী-পুরষের মধ্যে যে মানস-বিভাজনের জন্ম দিয়েছে, সেই বিভাজনরেখা কেন মুছে ফেলা দরকার—এই কথাটা বোঝাতে আজও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় তাদের ঘরে ঘরে, এমনকি সেখানে যদি চেতনায় সমৃদ্ধ পুরুষ থাকেন তাহলেও। অবশ্য শুধু ধৈর্যের ব্যাপার এটা নয়, সামগ্রিক সংগ্রামেরও অঙ্গ। সমাজপরিবর্তনের বৃহত্তর আন্দোলনেরই অংশ এই সংগ্রাম। নারী সমাজের অগ্রণী অংশ এই সংগ্রামটাও করে চলেছেন বহুদিন ধরে।
আক্কা মহাদেবীর কথা আমাদের অবাক করে। পতিগৃহে তাঁর ঠাঁই হয়নি। তাঁকে বিবস্ত্র হয়ে চলে যেতে হয়েছিল পরিবার ছেড়ে। তবুও তাঁর সাধনায় ভাটা পড়েনি। নিরাকার ঈশ্বর উপলব্ধি থেকে নিরীশ্বরবাদী ভাবনার স্তরে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কাশ্মীরকন্যা কবি লাল্লেশ্বরী ছিলেন শৈব ভক্তিবাদী দার্শনিক। বিয়ে হয়েছিল। সংসারের নিত্য যাতনার মধ্যেও কবিতা লিখতেন ‘বাখ’ কবিতা। সেই বাখগুলিতে বিবাহিত নারীর নিঃশব্দ যাতনা ও তার থেকে মুক্তি পাওয়ার আর্তি। শেষপর্যন্ত তিনি অবস্থান করেছিলেন ধর্মীয় ভাবধারার ঊর্ধ্বে।
ইলতুতমিসের কন্যা রাজিয়ার জীবনকথাও আমাদের মুগ্ধ করে। সেই সময়ে পর্দাপ্রথার বাইরে বেরিয়ে পুরুষতন্ত্রের খাসদুনিয়ায় স্বাধীন ও নির্ভীক প্রশাসক হিসাবে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তাকে খাটো করতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে তিনি একজন নারী। অন্য কোনও দোষ তাঁর ছিল না। এভাবেই রানী দূর্গাবতী, নূরজাহান,লুৎফুন্নিসা ইমতিয়াজ, রানী ভবানী, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কৃতী নারীদের কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইতে প্রথম মহিলা ন্যায়াধীশ আন্না চাণ্ডির কথাও যেমন আছে তেমনি আজাদ হিন্দ বহিনীর সেবাব্রতী লক্ষ্ণী সেহগল সহ প্রথম ইংলিশ চ্যানেল বিজয়িনী আরতি সাহার জীবনসংগ্রামের কাহিনিও আমরা পাই। কিভাবে আলোয় এলেন এইসব মহিলারা তারই বিবরণ সহজ সরল ভঙ্গিতে গল্পাকারে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, সব ধরনের পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে এই বই।
আলোর মেয়েদের গল্প
সুচেতনা মুখোপাধ্যায়। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। কলকাতা। ১২এ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। কলকাতা-৭৩। ২০০ টাকা।
Comments :0