মুক্তধারা | বই
লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার মহিলা বিজ্ঞানীরাও
প্রদোষকুমার বাগচী
ভারতের প্রথম আধুনিক মহিলা চিকিৎসক আনন্দীবাঈ যোশীর কথা মনে পড়ে? বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন। চৌদ্দ বছর বয়সে মা হয়ে নবজাতক শিশুকে বাঁচাতে পারেননি বলে সংকল্প করেছিলেন চিকিৎসক হবেন। সেই সংকল্পই কাল হলো। ডাক্তারি শাস্ত্র পাশ করে বিদেশ থেকে ফেরার পথে জাহাজে অসুস্থ হয়েছিলেন। জাহাজের বিদেশি পুরুষ ডাক্তার তাঁকে দেখেও দেখেননি। পরে দেশের ডাক্তারও তাঁকে স্পর্শ করেননি। এভাবেই নারী হওয়ার অপরাধে ২২বছরের সদ্য পাশ করা ডাক্তারকে সেদিন মেরে ফেলেছিল ভারতীয় সমাজ। কেবল ভারতে কেন, নারী হওয়ার অপরাধে প্রথম মার্কিন মহিলা চিকিৎসক ব্রুমল আন্নাকেও পেনসিলভেনিয়ার হাসপাতালে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। আন্নার কাজ আটকাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন পুরুষ ডাক্তাররা। কারণ ক্লিনিকে কাজ করার অধিকার একমাত্র পুরুষদের। এরকমই একের পর এক নারী বিজ্ঞানীর জীবন সংগ্রামের বিচিত্র কাহিনি আলোচিত হয়েছে ‘মহিলা বিজ্ঞানী অভিধান’ গ্রন্থে।
বইটি উলটে পালটে দেখতে দেখতে যে কোন পাঠক অনুভব করবেন দেশে বিদেশে সমাজের প্রতিটি স্তরেই সামাজিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছে নারী। এমনকি তাঁরা যদি বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকেন তাহলেও। ইতিহাসের কোনও কোনও পর্যায়ে অভিশাপ হিসাবেও চিহ্নিত হয়ে আছে তারা। কাব্য করে যদিও বলা হয় নারীরা অর্ধেক আকাশ। কিন্তু বাস্তবে নারীর মর্যাদা কতটা অস্বীকৃত থাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, তার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে এই ‘মহিলা বিজ্ঞানী অভিধান’ থেকে। মনুসংহিতায় স্পষ্ট বলা আছে পুরুষদের নষ্ট করাই নারীদের স্বভাব। তাই পণ্ডিতগণ যেন স্ত্রীলোক সম্বন্ধে সজাগ থাকেন।
সেই নির্দেশই কি মেনে চলেছিলেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রমন? নাহলে কমলা সোহানীর মতো কৃতী ছাত্রীকে বাঙ্গালোর ইনস্টিটিউট অব সাইন্স-এ গবেষক হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হননি কেন তিনি? কমলা সোহানী কিন্তু লিঙ্গবৈষম্যের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন। শেষে রমন তাঁকে শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করেন।
বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলও মনে করতেন নারী দেহগতভাবে আদতে কুপরিকল্পিত, অপরিণত পুরুষ। ‘মিসবিগোটেন মেল’। তাই জ্ঞানের জগতে, চিন্তার জগতে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতসহ অন্যান্য সভ্য দেশগুলিও মনে করত নারীদের শিক্ষার প্রয়োজন নেই। এমনকি বিংশ শতকেও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে প্যারিসের বিখ্যাত সায়েন্স আকাদেমিতে সদস্য করা হয়নি মাদাম কুরিকে। অথচ যুগ যুগ ধরেই দেখা গেছে উপযুক্ত পরিবেশ ও একটু সাহায্য সমর্থন পেলে নারীরাও অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তার প্রমাণ তাঁরা বহুবার দিয়েছেন। বিজ্ঞান চর্চাতেও বা তারা পিছিয়ে থাকবেন কেন? যেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেননি সেখানেও কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী, ভাই বা পিতার সহযোগী থেকেছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন কিন্তু প্রচারের আলো পান নি। নিজের গুণেই তাঁরা আলোকিত রেখেছেন নিজেদের। এই সব মহিলা বিজ্ঞানীদেরও সচিত্র জীবনকথা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে। এই বইয়ের সংকলকদ্বয় যে এঁদের কথাও মাথায় রেখেছেন তার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
এমনিতেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত থাকাটা একটি কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম। তার উপর নারীদের সেই কাজটা করতে হয় বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করে। উপেক্ষা করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একপেশে নিয়মকানুনের একাধিক চাপও। নারী সমাজের অগ্রণী অংশের বিজ্ঞানী মহলের এই সংগ্রামটাকেও তুলে ধরেছে এই বই। ১৭৮৬-র আগস্টে জার্মানির হার্শেল ক্যারোলিনের প্রথম মহিলা হিসাবে ধুমকেতুর আবিষ্কার, অথবা মার্কিন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হপার গ্রেস মুরির কম্পিউটারের ভাষা COBOL আবিষ্কার আমাদের মুগ্ধ করে। রাশিয়ান গণিতজ্ঞ সোফিয়া ছিলেন ইউরোপের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এমনকি প্যারি কমিউনেও অংশ নিয়েছিলেন। ইংরেজ পদার্থবিদ আয়ারটন হর্থা মার্কসকে বিজ্ঞানে অবদানের জন্য লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে গবেষণাপত্র পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁর আগে আর কোন মহিলা এই সুযোগ পাননি।
আবার সুযোগের অভাবে কত সম্ভাবনা যে অকালে ঝরে গেছে তার কোন হিসাব নেই। আইনস্টাইনের স্ত্রী মেরী মিলেভা অসম্ভব প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানী ছিলেন। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি (E=mc2) ও অনান্য গবেষণাপত্রের গণিতাংশের অনেকটাই যে মেরীর অবদান— ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। অথচ একথা কেউ মনে রাখেনি। আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, কিন্তু মেরীর কথা অনুচ্চারিতই থেকে গেছে। অন্যদিকে প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানী হজকিন ডরোথি যুদ্ধবিরোধী ছিলেন বলে এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যকে বিয়ে করেছিলেন বলে তাঁর আমেরিকা যাওয়া আটকে দেওয়া হয়েছিল। আইরিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনডর রাসেলকে নারী হওয়ার অপরাধে রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। ইহুদি হওয়ার অপরাধে হিস্টোলজিস্ট এল রীতাকে গবেষণাগার থেকে বার করে দিয়ে তাঁকে পথে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর নোবেল পাওয়া আটকাতে পারেনি ওরা। বইটি উলটে পালটে দেখলে এরকম বেশ কিছু মহিলা বিজ্ঞানীর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটবে যাঁদের কথা আগে সেভাবে আলোচিত হয়নি বাংলার কোনও পত্র পত্রিকায়।
দেশবিদেশের বরেণ্য মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে এত অল্পকথায় ও পরিপাটি আলোচনায় বাংলাভাষায় কোন জীবনী গ্রন্থ বেরিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ৩৬২জন প্রয়াত বিজ্ঞানীর জীবনকথা আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কথা আলোচিত হয়েছে দ্বিতীয় ভাগে। এমন সুপরিকল্পিত একটি বই আমাদের উপহার দেবার জন্য সংকলকদ্বয়কে পুনরায় ধন্যবাদ জানাই। বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বিজ্ঞান অনুরাগী মানুষের নানা প্রয়োজন মেটাবে এই বই।
মহিলা বিজ্ঞানী অভিধান
সুমিত্রা চৌধুরী ও জনরঞ্জন গোস্বামী। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। পি ২৩, রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট। কলকাতা ৭০০ ০০৬। ২০০ টাকা।
Comments :0