জন্মদ্বিশতবর্ষে
অমিত্রাক্ষরের স্রষ্টা
পল্লব মুখোপাধ্যায়
তাঁর ছন্দ তাঁর কাব্য, জীবনবোধ ও শিল্পচেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাঁর বিশিষ্ট ছন্দ
ভাবনায় তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ প্রকট। মধুসূদনের কবিপ্রাণ ছন্দের একটি ভঙ্গিকে বরণ
করে নিয়েছে। এই ছন্দে তাঁর কবিপ্রাণ অনুভব করেছে প্রথম উদ্বোধনের আনন্দ। এই
ছন্দের মার্জিত উৎকর্ষে তিনি নিয়োজিত করেছেন আপন সাধনাকে। এই ছন্দই অমিত্রাক্ষর। সনেটের
কলেবরে অন্ত্যানুপ্রাসের বহুল উপস্থাপন সত্ত্বেও অমিত্রাক্ষরের অনেক বৈশিষ্ট্যই
বজায় থেকেছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ থেকে মধুসূদনের কবিপ্রতিভাকে পৃথক করে নেওয়ার
কোনও উপায় নেই। এই ছন্দের দর্পনেই কবির আত্মপরিচিতি লাভ। তাই অমিত্রাক্ষর
ছন্দেরই অন্য নাম মধুসূদন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ কবির ভাবাবেগের স্তরেই নিছক আবদ্ধ থাকেনি, ছিল তাঁর সচেতন ভাবনার
আশ্রয়স্থল। অমিত্রাক্ষরে মধুকবির নিজস্ব চিন্তন পল্লবিত হয়েছিল শ্রুতিকে আশ্রয় করে। এই ছন্দের
মূলধর্মের অনেকাংশই তাঁর সচেতন চিন্তার আয়ত্তে এসে গিযেছিল।
মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে পরিলক্ষিত হয় যুক্তাক্ষর প্রধান সংস্কৃত ও বাংলা শব্দের বহুল
ব্যবহার। কঠিন শব্দের প্রয়োগ। কঠিন শব্দ বলতে যুক্তাক্ষরবহুল তৎসম বা খাঁটি সংস্কৃত শব্দের
কথাই বোঝাতে চেয়েছেন কবি।
অন্ত্যানুপ্রাসে বাহ্যিক মিলের সাহায্যে ধ্বনিসঙ্গীত সৃষ্টির যে প্রয়াস এতকাল ছিল তাকে গভীরতর ও
বিচিত্রতর ধ্বনিসৌন্দর্যের সৃষ্টির অঙ্গীকার করল এই নবীন ছন্দ। বাংলা যুক্তাক্ষরের বিচিত্র
ধ্বনিসৃষ্টির ক্ষমতা বিশেষ করে যুক্তাক্ষরপ্রধান সংস্কৃত শব্দকে বাংলা ভাষায় সহজে আত্মীকৃত
করার সম্ভাবনাকে এই উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছিলেন মধুসূদন । চরণের মধ্যে অনুপ্রাস ও যমকের
বহুল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুনিপুণ ব্যবহার এই সঙ্গীতধর্মকেই উচ্চকিত করে তুলেছে।
অমিত্রাক্ষরে প্রবহমান এক অবারিত সংগীতের স্রোত। এরই মধ্যে যুক্তাক্ষরপ্রধান শব্দগুলি,
অনুপ্রাস আর যমকগুলি যেন পার্বত্য ঝর্ণার উপলখণ্ডের মতো ছড়িয়ে। সংগীতের এই মূর্ছনা
যেমন এদের বাধাকে আশ্রয় করে সমান্তরালে এই বাধাকে অতিক্রম করেও।
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে মধুসূদন বলেছিলেন, বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দুহিতা বলে এ ভাষায়
অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি অবশ্যই সম্ভব। প্রত্যক্ষ আদর্শ হিসেবে তিনি মিল্টনকেই অনুসরণ
করেছিলেন। তাই তিনি বারংবার 'প্যারাডাইস লস্ট' পড়বার উপদেশ দিচ্ছেন। নতুন ছন্দের শিক্ষা
ওই সূত্র থেকেই লাভ করা সম্ভব।
যতিপাতের স্বাধীনতা এবং বৈচিত্র্য মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দের একটি প্রধান বিশিষ্টতা।
মধুসূদনের কবিসত্ত্বার বিপুল বিস্তার, চিন্তামুক্তির আকুতি, সর্ববাধা-উত্তীর্ণ বিদ্রোহী মানসিকতা
পয়ারের নির্দিষ্ট যতিপাতে কিছুতেই তৃপ্ত হচ্ছিল না। এই ছন্দ যেন মধুকবির যুগ ও জীবনচেতনাকে
যথার্থরূপে প্রকাশ করেছে। যতিপাতের স্বাধীনতাকে কবি মূলত ব্যবহার করেছেন ভাবের ও
আবেগের বিস্তার অনুযায়ী চোদ্দমাত্রাকে অতিক্রম করে আরও বহু মাত্রাকে আত্মস্থ করার অভিপ্রায়ে।
পদ্মাবতী নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবি লিখলেন,
জন্ম মম দেবকূলে, - অমৃতের সহ
গরলজন্মিয়াছিল সাগর-মন্থনে।
ধর্মাধর্ম সকলি সমান মোর কাছে
পরের যাহাতে ঘটে বিপরীত,তাতে
হিত মোর; পরদুঃখে সদা আমি সুখী...
এখানে নেই চরণান্তিক অনুপ্রাস। আছে যতিপাতে
পয়ারের বন্ধন থেকে মুক্তির চেষ্টা। যদিও স্বাধীন যতিপাতের বৈচিত্র্যের সম্যক উপলব্ধি হয়নি।
শব্দ প্রয়োগগত বিশিষ্টতা ধ্বনিসঙ্গীত সৃষ্টিতে সার্থক নয়। বিচিত্র উপায়ে অ্যাকসেন্ট, কোয়ান্টিটি
এবং সিল্যাবলে এর সমন্বিত তরঙ্গভঙ্গে সুরহিল্লোলের সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় না।
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে কবি লিখলেন,
বনদেব তপস্বী মুদিলা আঁখি, যথা
হেরি সৌদামিনী ঘনপ্রিয়ায় গগনে
দিনমণি। প্রথম চরণে 'তপস্বী' এবং 'যথা' শব্দদুটির প্রয়োগের ফলে সুর-সুষমা
বিপর্যস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞের মতে, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে অমিত্রাক্ষরের ছন্দ-সঙ্গীত মুখ্যত
মাধুর্যকে আশ্রয় করেছে, ওজস্বীতাকে নয়। বর্ণনার লিরিক স্বাদই এখানে মুখ্য, নাট্যরস এখানে
ঘনীভূত হয়নি।
মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে যতি ও সংগীতের মুক্তিতে যেমন রোমান্টিক গীতিধর্ম রণিত,
সুনিয়ন্ত্রিত অ্যাকসেন্ট, কোয়ান্টিটি-র মধ্যে তেমনই ক্লাসিকাল সংযম প্রতিফলিত। এই ছন্দের
অন্ত্যানুপ্রাস লোপে যেমন মধুসূদনের বিদ্রোহী কবিপ্রাণের মুক্তির দ্যোতনা, ছন্দোস্পন্দ সৃষ্টিতে ও
শব্দচয়নের নৈপুণ্যে তেমনই উদ্ভাসিত শিল্পী চেতনার স্বেচ্ছাবৃত সংযম সাধনা। এরই অপর নাম
সৌন্দর্য।
Comments :0