মুক্তধারা
গল্প
বিনাশপুর
সৌ র ভ দ ত্ত
ঘাসের ডগায় শিশির জমে ভোর হয়।এ গ্রামে সুদর্শন চৌকিদারের রাত পাহারার –জাগতে রহো… হাঁক শোনা যায় না আর।এক সময় নিশিরাতে পিঠে চিঠির বোঝা আর হাতে ঝোলা লন্ঠন নিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়াত ডাকহরকরা।শীত পড়লেই গাছে গাছে ঝুলত মাটির কলসি।খেঁজুর রসের টানে ছুটে আসত কত শত প্রাণভোমরা।মাঠে ডিপ টিউবওয়েলের মুখ নিয়ে হু-হু করে জল বেরোত।বোরো ধানে জল পাওয়াতে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হত চাষীর দল।এখন এখানকার ডিপটিউবয়েল গুলো অধিকাংশই অকেজো।শীতের মরসুমে গোকুলদের স্কুলের পিছনের মাঠে লিগ ক্রিকেট চলত।হসপিটাল প্রান্ত থেকে হেলেদুলে বল করতে আসত দুর্গা পণ্ডিত।
মাঝের পনেরো-বিশ বছরে গ্রামটার খোলনলচে এক্কেবারে বদলে গেল।গ্রামের নাম বিনাশপুর।
একসময় গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে রক্তিম আভার সূর্য উঠত সেখানে।সরকার বাড়ির মুনিষরা মাথায় বোঝা করে ধানখড় এনে খামারে ফেলত। বাদার দিকে কান পাতলে মেশিনে ধান কাটার শব্দ কানে আসে গোকুলের।কত চওড়া ছিল খেলার মাঠটা–ঘাসের গালিচা পাতা সেই ক্রিকেট মাঠেই কিনা আজ কংক্রিটের বেড়াজাল!
রূপনগরের উঠতি মস্তান–হ্যাবলা বিনাশপুরে এসে ঘাঁটি গাড়ল।একসময় সে লোহাঝালাই করত, তারও আগে সাইকেলের ভাঙা প্যাডেল আর লিক সারত।লোকে হ্যাবলাকে মজা করে প্যাডেলভাঙা বলে ডাকত।সে সময়ের হাবুল সিং হয়ে গেছে সব্বার হ্যাবলাদা।বন্দুকের নল ঠেকিয়ে প্লট করে জায়গা বেচাকেনা।অন্যের বউ ফুঁসলাতে, কিংবা পেটো বেঁধে বস্তা বোঝাই করে পাচার সবেতেই তার সূক্ষ্ম হাতের কারিকুরি।বাড়িটা মার্বেল দিয়ে মোড়া।বাড়ির ভিতরে একটা ডোবারম্যান সব সময় বাঁধা থাকে। নতুন রয়্যাল এনফিল্ড কিনেছে হ্যাবলা।দিঘায় সদ্য একটা ঝাঁ চকচকে হোটেল বানিয়েছে।দু-হাতে হাতে সোনার আঙটি।গলায় বকলেসের মতো মোটা চেন।প্রতিদিন সকালে বাজারে বেরোয় কলার দেওয়া ধূসর পাজামা-পাঞ্জাবি পরে।
ভয় দেখিয়ে, তোলাবাজি করে টাকা কামিয়ে বেশ কয়েক বছরেই তার আঙুল ফুলে কলাগাছ।অবশ্য টাকার উৎসে প্রচুর গন্ডগোল আছে। কানাঘুষো শোনা যায় দেশের বড় নেতার নাকি ওর মাথায় হাত আছে। এলাকার বিধায়ক পর্যন্ত তাকে সমীহ করে। হ্যাবলার প্রচুর টাকা।তারা ওকে ব্যবহার করে নির্বাচন এর কাজে।হ্যাবলার সাঙ্গপাঙ্গরা গত কয়েক বছরে 'বিনাশপুর' নামটাকে বেশ সার্থক করে তুলেছে।হ্যাবলার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে–সন্ন্যাসী হয়ে যেতে।হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগটাকে ধুয়ে তুলে ফেলতে।কিন্তু 'অঙ্গার শতধৌতেন!...মালিন্য কি যায়!
সেদিন খালপাড়ে হ্যাবলার দলবল নিমাই শতপথির বাগানটা জবরদখল করে নিল।ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে সাফ করে দিল গোটাবাগান।হ্যাবলা ঠিক করেছে মরা বৌয়ে'র নামে ওখানেই 'ললিতা সেবাশ্রম' করবে।পাশে দোকানঘর হবে।হ্যাবলার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে নিমাই বলেছিল–বাগানটা নেবেন না বাবু।ওটাতে আমার বাপঠাকুরদার হাতে লাগানো অনেক মূল্যবান গাছ আছে। কত পাখপাখালি, বন্যজন্তুর আশ্রয় আমাদের এই বাগানখানা। উত্তরে হ্যাবলা বলেছিল– দরকার হলে তোর ভিটেটাও নিয়ে নেব। নিমাইরা তিনভাই।একজনের আনাজের ব্যবসা। অন্যজন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী।নিমাই পাড়ায় পাড়ায় সংকীর্তন করে।শীত এলে লোকের বাড়িতে নগরকীর্তনে বেরোয়।ওর মেয়েটা বড় হয়েছে। শহরের কলেজে যায়-আসে।বাঁশের মাচায় বসে তাস পিটতে পিটতে হ্যাবলারা তারদিকে কেমন বিশ্রী চোখে তাকায়। সেদিন সন্ধ্যায় সাকরেদদের সাথে করে হাবুল ওরফে হ্যাবলা হাজির হল নিমাইদের বাড়ি।প্রথমে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, তারপর মারধর।বাবাকে অপমানিত হতে দেখে মেয়েটা পড়ার ঘর থেকে আগল খুলে বেরিয়ে এসেছিল।এ ছুঁড়িকে নিয়ে চল আজ রাতে জোর মোচ্ছব হবে--বলতে বলতে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল হাবুলের দলবল।
পরদিন কুহুকাবৃত সকালে জলার পাশের কুশঘাসের ঝোপে একটা অর্ধনগ্ন মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখল গ্রামের মুনিষরা।ঘাসের উপর শিশির না, চাপ চাপ রক্ত….!প্রশ্ন জাগল সবার।
দূর থেকে যেন সুদর্শন চৌকিদারের ডাক ফিরে ফিরে এলো–জাগতে রহো…জাগতে রহো…
ReplyForward Add reaction |
ReplyForward Add reaction |
ReplyForward Add reaction |
Comments :0